মনসুর হেলাল

  ৩০ জুলাই, ২০২১

সাহিত্যে সৃজনশীলতা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

যেকোনো কাজের পূর্বশর্ত হচ্ছে সৃজনশীলতা। আর সে কাজটি যদি হয় পাঠাগারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তখন এর সঙ্গে পঠনপাঠনের দিকটিও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। পাঠাগারে আসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পাঠক। যারা তাদের মনস্তত্বের অন্তর্নিহিত ক্ষুধা নিবৃত করতে চায় অপার আনন্দে। একটা সময় ছিল, পুস্তকপাঠে আনন্দ হতো। আনন্দের রেশ সমাজে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে এমনকি মানুষের জীবনেও রাখত দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। মনের কোনায় রেখে যেত পুস্তকের অন্তর্নিহিত বার্তা। এখনকার সমাজে পাঠক আছেন, বই প্রকাশিত হয় অজস্র্র, বিভিন্ন পাঠাগারে গিয়ে সেই বইয়ে মনোযোগী হন বিদগ্ধ পাঠক। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় তার কোনো প্রভাব নেই!

উল্লিখিত কথাগুলো মনগড়া নয়। এগুলো পাঠকদের অভিব্যক্তি বর্তমান লেখকদের প্রতি। কি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিংবা নাটক; কোনো কিছুই পাঠকের মনে ধরছে না। এটা কীসের সংকট? পাঠকের? না লেখকের লেখনীর? তারা বলছে ‘মানসম্মত বইয়ের অভাব আমাদের সাহিত্যকে অন্ধকারে তলিয়ে নিচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করছে দেশীয় সাহিত্য থেকে।’ পাঠকের অভিযোগ হয়তো কষ্ট আনতে পারে লেখকের মনে। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে মানসম্মত বই যে বাংলাদেশে হচ্ছে না তা কিন্তু একদম ঠিক নয়।

সম্প্রতি ‘জয়তী’ নামের একটি পাক্ষিক পত্রিকার পক্ষ থেকে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ‘বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে পাঠকের মতামত’ শীর্ষক একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। ব্যাপক অর্থে জরিপকাজে কথাসাহিত্যিক আহমদ বশীর, কবি মনসুর হেলাল ও ‘জয়তী’ সম্পাদক মাজেদুল হাসান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানের ৬০০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রকৌশলী-উকিল-সাংবাদিক-এনজিও কর্মীরা অংশ নেন। জরিপের উদ্দেশ্য ছিল, বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ কী ধরনের বই পড়েন, বইগুলো পড়ার জন্য কীভাবে নির্বাচিত করেন, বইগুলোর কথা কেন মনে রাখেন এ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করা। এ ছাড়া বাংলাদেশের সাহিত্য এবং ভারতীয় বাংলা সাহিত্য এ দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি পাঠ করা হয় তা নিরূপণ করা ছিল জরিপের লক্ষ্য। জরিপে ১১টি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল পাঠকদের সামনে। প্রশ্নগুলোর উত্তর যা এসেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর।

জরিপে দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা বই পড়েন। ১৬ শতাংশ উত্তরদাতা একেবারেই বই পড়েন না। এরই মধ্যে উপন্যাস পড়েন ৬৪ শতাংশ, গল্পের বই পড়েন ৪৪ শতাংশ, রহস্য উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন ৩১ শতাংশ, কবিতার বই ২৯ শতাংশ, প্রবন্ধ ২১ শতাংশ, রম্যরচনা পড়েন ২১ শতাংশ, ভ্রমণ কাহিনি ১৮ শতাংশ, নাটক ১৭ শতাংশ, শিশুসাহিত্য ১২ শতাংশ আর অন্যান্য বই পড়েন ৪ শতাংশ পাঠক।

পাঠক কোন বিষয়ের বই পড়তে ভালোবাসেন তা নিয়ে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল জরিপে। ১৫টি ক্যাটাগরিতে পাঠকের মতামত চাওয়া হয়। জরিপে দেখা গেছে, সামাজিক জীবনের বর্ণনামূলক বই পড়েন ৪৫ শতাংশ, যেসব বইয়ের মূলবস্তু থাকে প্রেম এমন বই পড়েন ৩৮ শতাংশ, বৈজ্ঞানিক বই পড়েন ৩০ শতাংশ, ইতিহাস সাশ্রয়ী বই পড়েন ২৯ শতাংশ, রাজনৈতিক বই ২৯ শতাংশ, দর্শনের বই ২৩ শতাংশ, অনুবাদ ২৩ শতাংশ, রূপকথার বই ২৩ শতাংশ, ব্যঙ্গ-কৌতুকের বই ২৩ শতাংশ, ধর্মবিষয়ক বই ১৯ শতাংশ, অর্থনৈতিক বই ১৭ শতাংশ, খেলাধুলার বই ১৭ শতাংশ, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে লেখা বই ১৬ শতাংশ, গবেষণামূলক বই ১১ শতাংশ, আত্মজীবনীমূলক বই ৪ শতাংশ পাঠক।

জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বই পড়া হয়েছে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের। একাকী হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়। ২০ শতাংশ পাঠক এ অভিমত দিয়েছে। অন্যদিকে ১ শতাংশ উত্তরদাতা যাদের নাম উল্লেখ করেছেন, তারা হলেন প্রমথ চৌধুরী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, সত্যজিত রায়, সৈয়দ শামসুল হক, আরজ আলী মাতুব্বর, দস্তয়ভস্কি, নিকোলাই অস্ত্রভস্কি, রাকিব হাসান, আর্থার কোনান ডায়েল, ড্যান ব্রাউন, মাহফুজুর রহমান, রফিকুন নবী, আলী ইমাম, মুনির চৌধুরী, সফি উদ্দিন আহমদ, হরিশংকর জলদাশ, যতীন সরকার, সত্যেন সেন, সজল আহমদ, মিহির সেনগুপ্ত ও তাহমিনা কোরাইশী। আশ্চর্য হলো, হিটলারের মাইন ক্যাম্প পড়েছেন ১ শতাংশ, ওমাবার মাই ফাদারস ড্রিম পড়েছেন ১ শতাংশ পাঠক।

জরিপে একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল পাঠক যে বইগুলো পড়েছে তা কীভাবে তাদের হাতে এসেছে। এর কারণ হচ্ছে পাঠকের চাহিদা আছে কিন্তু জোগানের মাধ্যমটা কী তা পরীক্ষা করা। প্রশ্নের উত্তরে দেখা গেছে, কিনে পড়েছেন ৩৫ শতাংশ, উপহার হিসেবে পেয়েছে তাই পড়েছেন ২৫ শতাংশ, পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে বই পড়েছেন ৫ শতাংশ, ধার করে পড়েছেন ২০ শতাংশ, অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে কিনেছেন ২ শতাংশ পাঠক। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশে আরো অসংখ্য লেখক থাকা সত্ত্বেও তাদের নাম তারা কেউ উল্লেখ করেননি।

দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশ এবং পশ্চিবঙ্গের ভাষা একই হলেও মূলত দুই ধারায় এই সাহিত্য বহমান। পাঠকও আলাদা আলাদা। এ জরিপেও উঠে এসেছে সে বিষয়টি। জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ভারতীয় বাংলা সাহিত্য পড়েন ২২ শতাংশ। জরিপে ব্যতিক্রমী একটি পাঠক-প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। যার সুচিন্তিত উপস্থাপনা সত্যিকার অর্থে এখনো আশান্বিত করে তোলে। পাঠক প্রতিক্রিয়াটি হুবহু তুলে ধরা হলো ‘বাংলা সাহিত্য না ভারতীয় সাহিত্য বেশি ভালো লাগে তা একবাক্যে বোঝানো সম্ভব নয়। কেননা, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের সাহিত্যের বয়স ও ভারতীয় সাহিত্যের বয়সে ব্যাপক পার্থক্য। বস্তুত বাংলা সাহিত্য বলতে তো ভারতীয় বাংলা ও এই বাংলা একই ছিল। মাত্র ৫১ বছর আগে বাংলাদেশের জন্ম এবং নতুন করে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের সৃষ্টি। বাংলা রেনেসাঁসের সময়টায় বাংলা বলতে একটা অঞ্চলই ছিল, তাই তখন এ সাহিত্যগুলো ছিল অধিকতর অর্থপূর্ণ, এই ৪৬ বছরের বাংলাদেশের সাহিত্যে থেকে। তাই আমার নিজের দেশ হলেও এখানে বাংলা সাহিত্যকেই অগ্রগণ্য হিসেবে দেখতে হয়। এ ছাড়া একটি বিষয় সততার সঙ্গে প্রকাশ করতে চাই, তা হলো বাংলাদেশের সাহিত্য আমার তুলনামূলক অনেক কম পড়া হয়েছে। কেননা সাহিত্য বলতে আমরা যে রবীন্দ্র, নজরুল, মানিক, তারাশঙ্কর বুঝি তারা তো ভারতীয় বাংলার-ই। তাই আলাদা করে বাংলাদেশের সাহিত্য না পড়ে বিচার করা অনুচিত। তবু যে কতেক বই পড়েছি, তার ভিত্তিতে বললে, বলতে হয় বিশ্বসাহিত্যের সংস্পর্শ পাওয়ার পর আমাদের দেশের সাহিত্যগুলো খুবই সাধারণ মানের মনে হয়েছে।’

অথচ যে দেশের সাহিত্যাঙ্গনে শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ ইত্যাদি শক্তিমান লেখকদের জন্ম। সে দেশের পাঠকগোষ্ঠী তাদের বইয়ের স্বাদ আস্বাদন থেকে বঞ্চিত! আমাদের রস আস্বাদনের যে মান, তাকে অতিক্রম করেই তো উপরোল্লিখিতরা বাংলাদেশি সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল। তবে কেন তা পাঠক পড়ছেন না? এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলে ফিরে যেতে হবে জরিপের ফলাফলের কাছে। তবে একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমাদের সাহিত্যাঙ্গন দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ফলে। রাজধানীর বাইরে প্রচুর পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না সমসাময়িক সাহিত্যকে। যার ফলে বই বিক্রির হার কমছে দিনকে দিন। কমে যাচ্ছে পাঠকশ্রেণি। ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতে প্রকাশনা জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সৎ প্রকাশকরা। আমাদের সাহিত্যকে বাঁচাতে হলে সারা দেশে বই বিপণনের পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা-সংবলিত মানসম্মত গণপাঠাগার। যেখানে শ্রেণি-পেশাভেদে সব ধরনের পাঠক

বই পড়ার অবাধ সুযোগ পাবেন। তাহলেই হয় তো আমাদের সাহিত্যের বন্ধ্যত্ব কিছুটা ঘুচবে। তৈরি হবে লেখক-পাঠকদের মেলবন্ধন, যা আমাদের প্রত্যাশা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close