reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৮ জুন, ২০২১

বই আলোচনা

সাংবাদিকতা : দর্পণেরও থাকে সীমাবদ্ধতা

সাংবাদিকতা এক জ্ঞানদায়ী পেশা। এ পেশায় প্রতিনিয়ত শিখতে হয়। এই শিক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় গণমাধ্যমবিষয়ক বইপত্র, নিতে হয় প্রশিক্ষণও। তবে গণমাধ্যমে কাজ করতে করতেই সাংবাদিকতায় আসল প্রশিক্ষণ হয়। কাজের মধ্য দিয়ে সিনিয়রদের গাইডেন্সে একজন শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মী হয়ে উঠেন পরিপক্ব, নিপুণ ও নিখুঁত সংবাদ লিখিয়ে, তার লেখা প্রতিবেদন সমাজে ও রাষ্ট্রে আলোড়ন ফেলে দেয়। সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মীকে দল-মতের ঊর্ধে থাকতে হয়। কালোকে কালো, সাদাকে সাদা বলতে হয় নিঃশঙ্ক চিত্তে। পেশাগত নীতিবোধের বেলায় কারো রক্ত চোখের কাছে আপস করেন না একজন প্রকৃত সাংবাদিক। তার মাথা নত হয় না সম্পদের লোভ-লালসার কাছে। তবে ভুললে চলবে না, সাংবাদিককে কাজ করতে হয় গণমাধ্যমের নিয়মনীতি মেনে। তিনি লঙ্ঘন করতে পারেন না রাষ্ট্রের আইনকানুন ও সমাজ মননের আবেগ-অনুভূতি।

কবি ও লেখক মনসুর হেলাল এমনি এক পেশানিষ্ঠ সাংবাদিক ও তরুণ বুদ্ধিজীবী। সব সময়ই তিনি অনুভব করেন সাংবাদিকতার মান আরো উন্নত হওয়া উচিত। এই পেশাকে আরো গণমুখী এবং মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ করতে হলে নতুন প্রজন্মের গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য বাংলা ভাষায় দরকারি বই, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় না। এই অভাব মেটানোর বুদ্ধিবৃত্তিক তাগিদ থেকেই তিনি সম্পাদনা করেছেন গণমাধ্যমবিষয়ক একটি বই। নাম দিয়েছেন ‘সংবাদপত্রে সমাজ দর্পণ’। বইটির প্রকাশক য়ারোয়া বুক কর্নার। বইটি আমার হতে আসার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করেছি এর প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কাগজের মান ও অঙ্গসৌষ্ঠব। এরপর খুব আগ্রহ নিয়ে বইটি পাঠ করেছি। বইটিতে স্থান পেয়েছে আমাদের সাহিত্য ও গণমাধ্যম জগতের তপনতুল্য মনীষা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লেখক ও গবেষক মযহারুল ইসলাম বাবলা, কথাসাহিত্যিক আহমদ বশীর, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হাসান, কবি ও সাহিত্যিক অরূপ তালুকদার এবং বাংলা লেখায় ভুল ও গুরুচ-ালি ধরার মেধাবী মানুষ ড. তপন বাগচীর লেখা। এ ছাড়া বইটিতে যাদের লেখা সম্পাদক জোগাড় করেছেন তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন। আমাদের সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অঙ্গনে সুনাম কুড়ানো এসব লেখক ও গণমাধ্যম গবেষকদের রচনা এই গ্রন্থে জায়গা পাওয়ায় বইটির অ্যাকাডেমিক মান বজায় থেকেছে। এ কারণে বইটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রয়োজন মেটাবে। কাজে লাগবে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সিটিজেন জার্নালিস্টদের। তা ছাড়া ফেসবুকে যারা লেখালেখি করেন তাদেরও কাজে আসবে এই বই।

স্বীকার করতেই হবে, দেশ-বিদেশের নানামুখী সমাজচিত্র, রাজনীতি ও সংস্কৃতির খবর ও ছবি নিয়ে সাঁজ সকালে মানুষের হৃদয়-দুয়ারে কড়া নাড়ে এই গণমাধ্যমই। শানিত করে ব্যক্তি মানুষের চৈতন্যবোধ, আত্মসচেতনতা। এ কথা অকাট্য সত্য যে মানুষকে আয়নার সামনে প্রতিনিয়তই দাঁড়াতে হয়, নিজের চেহারার রকম-ফের বোঝার জন্য। কিন্তু আয়নায় তো দেহের পেছনের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয় না। আয়না আমাকে দেখাতে পারে না আমার ঘাড়-পিঠ-কটিদেশের হাল কী? স্মরণ রাখতে হবে সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও পশ্চাৎদেশ আছে, অন্ধকার এলাকা আছে, যেখানে আলো-আঁধারিতে সুরা-সাকির আসর জমিয়ে যড়যন্ত্রে মাতেন রাষ্ট্র ও সমাজের শত্রুরা। হতে পারেন এরা গডফাদার, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ক্ষমতাধর কিংবা কোনো সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী। এদের ভালোমানুষির মুখোশ খুলে দেওয়াও গণমাধ্যমকর্মীর অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে গিয়ে প্রতি বছর পৃথিবীর দেশে দেশে যশোরের শামসুর রহমান, ফরিদপুরের প্রবীর শিকদার, ফেনীর টিপু সুলতান এবং সৌদি আরবের জামাল খাশোগি হতে হয় ডজন ডজন গণমাধ্যমকর্মীকে। তারপরও গণতন্ত্র, সুশাসন ও দেশবাসীর কল্যাণের প্রয়োজনে এই মরণঝুঁকির চ্যালেঞ্জ গণমাধ্যমকে নিতেই হয়; প্রতিনিয়ত, ক্রমাগত।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করছে। উদযাপন করছে মুজিবশতবর্ষ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উঠতে যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। বিশে^ এই মর্যাদাবান রাষ্ট্র হতে গেলে আমাদের গড়তে হবে জ্ঞাননির্ভর সমাজ। এই যে জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়ার কাজ এখানেও গণমাধ্যেমের বিস্তর করণীয় আছে। এ জন্য দরকার হবে স্বাধীন গণমাধ্যম। এই করণীয় সুচারুভাবে পালন করতে হলে সংবাদমাধ্যমকে হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ। পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোতে থাকতে হবে যুগোপযোগী সম্পাদকীয় নীতিমালা, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল, আধুনিক জীবনদৃষ্টি এবং বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবোধ। অন্যদিকে গণমাধ্যমকে বেড়িয়ে আসতে হবে প্রচীনপন্থি গোঁড়ামি এবং কল্প-কাহিনি নির্ভর অপসাংবাদিকতা থেকে। এ কথা বলছি এ কারণে যে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও ‘নিজের ও দলীয় বিশ^াসের রং মাখানো’ ভেজাল সাংবাদিকতা আমরা দেখেছি। এই ধারার হলুদ সাংবাদিকতার নেতৃত্বে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিজ্ঞানমনস্কতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তি। প্রতিক্রিয়াশীল এই সমাজশক্তি প্রগতির চাকাকে পেছনে ঠেলতে চায়, স্বীকৃতি দেয় না নারী-পুরুষের সমান অধিকারে। এদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের। বইটির সম্পাদক ও প্রকাশককে ধন্যবাদ জানাই সাংবাদিকতা-বিষয়ে প্রয়োজনীয় এই বইটি প্রকাশের জন্য।

মো. শহীদুল্লাহ

সংবাদপত্রে সমাজ দর্পণ : মনসুর হেলাল, প্রকাশক : য়ারোয়া বুক কর্নার

প্রচ্ছদ : ঋতু চৌধুরী, দাম : ৩০০ টাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close