ইলিয়াস ফারুকী

  ১৮ জুন, ২০২১

গল্প

নিজেকে খুঁজেছি অনেক

সারা রাত বসে বসে কায়মনোবাক্যে নিজেকে নিজেই উদ্বুদ্ধ করলাম আজ একটা কিছু হবেই। অনেক দিন পর নিজের ভেতরের আত্মবিশ্বাস মাথা উঁচু করেই উঁকি দিচ্ছিল। অজানা ইন্দ্রিয় সাড়া দিচ্ছিল আজ ভালো একটা খবর পাওয়া যাবেই।

তখন আমার চাকরির ভীষণ প্রয়োজন। পরিবারের প্রয়োজনে এবং নিজের জীবনের প্রয়োজনেও। অনুকে আপন করে পেতে হলে বেকার নামের তগমা ছুড়ে ফেলতে হবে। মাঝে মাঝে মানবজীবন নিয়ে আশ্চর্য হয়ে ভাবি। সৃষ্টিকর্তা বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বানিয়ে দিলেন ঠিকই। আবার সেই মানুষকে একেবারে অসহায় করে ছেড়ে দিলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান-ভালোবাসা এসব কিছুর নিয়ন্ত্রক হিসেবে অর্থনৈতিক অবস্থানকে নেতৃত্বে স্থান দিয়ে দিলেন। পশুর মস্তিষ্ক করে দিলেন ‘চিন্তা’ নামক আইকনহীন। আর সেই আইকনটা খুবই চতুরতার সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কে বসিয়ে দিলেন। আর প্রমাণ করার জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন ‘মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব।’

ছোটবেলার বন্ধু মঈন আর আমি। একসঙ্গে একই বিভাগে পড়েছি। আমাদের মাঝে পার্থক্য, আমি আবেগী আর মঈন বাস্তববাদী। কিন্তু পারিবারিক অর্থনীতিতে আমাদের দুজনের পরিবারই একই অবস্থানে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পরিবার আমাদের কাছ থেকে আশার স্বপ্ন দেখে। তাই আমার বাস্তববাদী বন্ধু কোনো ধরনের বাছ-বিচার না করে একটি আলুর আড়তে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজে লেগে গেল। বন্ধু উৎকট বোনাস হিসেবে আমাকেও সঙ্গে নিল। মঈনের কক্ষ ও বিছানা ভাগাভাগি করি। সকালে বন্ধু যখন গদিতে বসে, আমি তখন ফিটফাট হয়ে আধুনিক চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ি। প্রতিদিন সকালে আমার জন্য বরাদ্দ কুড়ি টাকা। পকেট মঈনের, খরচ আমার। বন্ধুর খরচে খাই-দাই আর ঘুমাই। সময় হলে খরচের টাকা নিয়ে চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ি।

সালটা চুরাশি/পঁচাশি। বন্ধুর খাজাঞ্চিখানা ও সরাইখানা রয়েছে তাই ঢাকায় থাকা-খাওয়ার চিন্তা নেই। কোনো দিকেই কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সকালে বাবু হয়ে বের হই। বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে চাকরির জন্য হানা দিই। পরিচিত, অপরিচিত সব জায়গায় যাই। কিন্তু চাকরির দেখা মিলে না। কারণ কোথাও কর্ম খালি নেই তো কোথাও পদের জন্য আমার ফলাফল ভালো না। বিভিন্ন অজুহাতে চাকরি নামের স্বপ্ন আমার থেকে দূরেই থাকছে। এত কিছুর মাঝেও অনুকে ঠিকই সময় দিয়ে যাচ্ছি। আমার পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনু ভালো করেই জানে। তার কাছে কখনো কিছুই গোপন করি নাই। প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমার অবস্থান খুবই পরিষ্কার। যার সঙ্গে জীবনকে একসঙ্গে বাঁধব তার সঙ্গে কোনো লুকোচুরি নেই। চাকরি পাওয়া এবং অনুকে পাওয়া দুটোই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ইনসুলিন ছাড়া শর্করা কোষে প্রবেশ করে না। তেমনি চাকরি ছাড়া অনুকে পাওয়া অসম্ভব। চাকরিটা এখন আমার জীবনের ইনসুলিন।

কায়মনোবাক্যের ইচ্ছাপূরণ হলো। অবশেষে চাকরি পেলাম। কিন্তু আমার ভালোবাসার মানুষ এবং শহর ছেড়ে অনেক দূর। আমাকে যেতে হবে সিলেট। ইনসুলিন পেলাম তবে অনেক দামি। মঈনের কাছে চাকরিতে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। কিন্তু মঈন স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ‘যা পেয়েছিস আগে যোগদান কর, পরে দেখা যাবে কী করা যায়।’ আমার কাছে মঈনের স্বরটা একটু কঠিন মনে হলো। কিন্তু চুপ থাকলাম। মনে মনে ভাবলাম, মঈন হয়তো আমাকে আর তার সঙ্গে রাখতে চাচ্ছে না। হয়তো বিরক্ত। কিন্তু পরক্ষণেই আমার ভুলটা ভাঙল। মঈনের কণ্ঠে নরম সুর শোনে। ‘দেখ, মন খারাপ করিস না। আমি তোকে ভাগিয়ে দিচ্ছি না। তোর পরিবারের কথা চিন্তা করেই বলছি। আমাকে দেখ না, এমএসসি পাস করে একটা আড়তের ম্যানেজারি করছি! কেন? বাপের ঘাড়ে আর কত। তুই যা আগে যোগ দে। পরে একটা ভালো চাকরি খোঁজ করে অন্য জায়গায় চলে যাবি। আর যদি মোটেই ভালো না লাগে আমার এখানে তোর জন্য সব সময় অবারিত দ্বার’। চিন্তা করলাম এরপর আর কোনো কথা থাকতে পারে না।

তথাস্তু বলে নিজের প্রাণকে মেহমান বানিয়ে জীবনের প্রচণ্ড স্রোতে লাফিয়ে পড়লাম। জানি না এই স্রোত কোথায় গিয়ে ঠেকবে। কোথাও কুল পাবে আমার বিশ্বাস। অনুর চিন্তা মাথায় জেগে বসল। ওকে না পেলে যে মরে যাবো। মাথায় প্রায়ই মৃত্যুর চিন্তা আসে। মানুষের মৃত্যুচিন্তা মানুষকে কী পরিমাণ পেছনে ঠেলে দেয়। তবু প্রেরণা পাই। অদ্ভুতভাবে আমার প্রেরণা আসে মানবকুল ঘৃণ্য একটা প্রাণী মশা থেকে। ক্ষুদ্র একটা প্রাণী অথচ মৃত্যুর কোনো ভয় নেই। পুরুষ মশার কাছ থেকে লড়াই করার। লড়াই করে সে তার জীবন রাঙায় নিজের মতো করে। আর নারী মশা মৃত্যুর সমূহ আশঙ্কা নিয়েও অবলীলায় রক্ত চুষে নেয়। দুই কিংবা তিন সপ্তাহের জীবন অথচ কত বর্ণাঢ্য। কাউকে হুজুর হুজুর করতে হয় না। উল্টো তারাই সমীহ আদায় করে নেয়। আমাকেও বেঁচে থাকার জন্য জীবন লড়াই করতে হবে। জীবন নিজের গতিতে এগোতে থাকল। পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলেও স্বাভাবিকতার একটা মৃদু বাতাস বইতে শুরু করল। চাকরি জীবনের সাত-আট মাস কাটিয়ে ফেললাম। পিতা-মাতা, ভাই-বোনের জন্য টান ঠিকই অনুভব করলাম। কিন্তু অনুকে দেখার জন্য নিজের ভেতরে নায়াগ্রার জলপ্রপাত অনুভব করতে থাকলাম। তাকে একবার দেখার জন্য অবেলায় হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠল। কাউকে ভালোবাসলে তাকে দেখার জন্য কী বেলা অবেলার প্রয়োজন রয়েছে। তবু অবেলা বলছি এজন্য যে, এ মুহূর্তে দাপ্তরিক কাজে ভীষণ ব্যস্ততা। অনুভূতি থাকলেও প্রেম, ভালোবাসা এই সময় হৃদয়ের শব্দদূষণমুক্ত কক্ষে বিশ্রামরত। কিন্তু আজ হঠাৎ কেন যেন তার দর্শন লোভ আমার ভেতরে উদগ্রীব হতে থাকল। চাকরিতে যোগদানের পর এই প্রথম ছুটির জন্য আবেদন করলাম। তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর হলো। রাতেই ঢাকার বাসে চড়ে বসলাম।

চৈত্রের প্রচণ্ড খরা জনপদে তার রুক্ষতা ছড়াচ্ছে। আমি অনুর সঙ্গে দেখা করার জন্য তার দেওয়া স্থানে গিয়ে উপস্থিত। গিয়ে দেখি অনু আমার পূর্বেই সেখানে হাজির। যদিও বসন্ত না। এমনকি বসন্ত ঋতুও না। তবু লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরেছে। দুটো বেণি যা ঝুলিয়ে না রেখে মুড়িয়ে আবার সুন্দর একটা অবয়ব দিয়েছে। তার নিজেকে এই যে তৈরি করা। বসন্ত না আবার বাসন্তিক আবহাওয়া তৈরি করা আমাকে মাতাল করে তুলল। অনেক দিন পর দেখা। কারো কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই। নিস্তব্ধতা যেন গুমোট মেঘ হয়ে জমে আছে। ভাষা ঊহ্য হয়ে কথা যেন হারিয়ে গেছে। এই কবর নিস্তব্ধতা ভাঙার জন্য একটা জুতসই শব্দের খুবই প্রয়োজন। হঠাৎ লক্ষ করলাম, অনুর চোখ সমুদ্র পাড়ের ভেজা বালির মতো জলজ হয়ে উঠছে। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ঝট করে তার হাত টেনে নিলাম নিজের দু’হাতে। কিন্তু পরক্ষণেই থমকে যেতে হলো। অনুর কাছ থেকে কোনো রকম প্রতিক্রিয়াই পেলাম না। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আর একবার মাটির দিকে তাকিয়ে খালি পায়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বিহ্বল কণ্ঠে জানতে চাইলাম, ‘এত দিন পর দেখা কিছু বলছো না কেন’। তবু সে নির্বাক। আমার ভেতরে ততক্ষণে সুনামি শুরু হয়ে গেছে, সন্দেহ বুমেরাং হয়ে বারবার আমার চোখের সামনে থেকে ঘুরে যেতে থাকল। আবার বললাম, ‘কিছু কী হয়েছে’? এবার মুখ খুলল সে, ‘আমাকে ভুলে যাও আবির’। উড়ন্ত চিল যেমন ছোঁ মেরে তুলে নেয় সাঁতরানো মাছকে, তেমনি তার মুখের কথা মাঝপথে কেড়ে নিলাম আমি। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম ‘তোমার কথা স্পষ্ট করো অনু, কী বলতে চাও তুমি’?

‘মাকে তোমার কথা বলেছিলাম। তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি কথা বলার একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন’। অনুর কথাগুলো শুনে পুরো শরীর বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কেঁপে উঠল। ভেতরে ভালো না-লাগা ধূম্র যেন দম আটকে ফেলতে উদ্যত হলো। আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম ‘মানে’! আমার চিৎকারে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে একটু চড়া কণ্ঠেই বললাম, ‘দুঃখিত’, যাতে পথচারীরাও শুনতে পায়। অনুর কথায় ভেতরের বিস্ফোরণকে সংযত রেখে অনুকে বললাম, এ কী বললে তুমি। তিনি রাজি না হতে পারেন, তাই বলে একেবারে অজ্ঞান! নিজেকেই নিজের কাছে খুব ছোট মনে হলো। অনুকে বলতে চাইলাম, আমি কী এতটাই...। আবেগে কথা থেমে গেল। কিন্তু অনু নীরব থাকল, আমার কথার কোনো প্রতি-উত্তর করল না। অনেকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। হঠাৎ অনু বলল, ‘আমাকে যেতে হবে আবির’। আমি কোনো কথাই বলতে পারলাম না। বোবা হয়ে দেখলাম, অনু অবিচলিত পদে ধীরে ধীরে হেঁটে অদূরে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close