জোবায়ের মিলন

  ১৬ এপ্রিল, ২০২১

বিষাদে বিদায় বইমেলা

অবশেষে শেষ হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। নির্ধারিত সময়ের দুই দিন আগেই পর্দা নামাতে হলো মারিকালের ছোবল ভয়ে। শেষ দিনের বিকালে দেখা গেল মাঠ ভরা ছড়ানো-ছিটানো মানুষ। বইয়ের মানুষ। মুখে মুখে বিকালের ছাপ। পায়ে পায়ে পাওয়া না পাওয়া পয়ার। যেন ‘যেতে নাহি দেব, হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’।

শুরুটাও তো এভাবেই। কী যেন হয়, কী যেন হয়! শুরু হলো। এ শেষ প্রত্যাশায় ছিল না। কাঠখর পুড়িয়ে বহু ঝক্কি মাথায় নিয়ে বসেছিল এই গ্রন্থমেলা, আমরা যাকে ডাকি বইমেলা। বইয়ে বইয়ে পূর্ণও হয়েছিল। পরিপূর্ণ হলো না। মরণ-রোগের আতঙ্ক, বাস্তবতা বার বার নাড়িয়ে দিয়ে গেল এ বছর বইমেলাকে। সকালে এক সুর তো বিকালে আরেক সুর। বিকালে এক সুর তো পরের সকালে আরেক! সিদ্ধান্তহীনতা হাবুডুবু খাইয়ে ছেড়েছে আয়োজনে অংশ নেওয়া অংশীদের। তারপরও দরজা খুলেছে, মানুষ এসেছে, বেচা-কিনি হয়েছে টুকটাক। হিসাব মতে, জানা গেল বিস্তর ক্ষতি। গত বছর কোটির ঘর বিরাশি, আর এ বছর মাত্র তিন! ক্ষতি যে হবে তা আগেই ধারণায় ছিল কিন্তু এমন ক্ষতি! ভাবনায় আসেনি। ছয় নয় না হলে হয়তো আরো একটু ওঠে আসত, হলো না। কারা, কীভাবে, কি বুঝে-শুনে, কি মত জারি করল নানা সময়ে তা এক রহস্য। ঘুরে দাঁড়াবার বদলে ঘুরে আছড়ে পড়া।

শুরুটাই কি ভুল ছিল? নাকি শেষটা? মুখে মুখে ঘুরেছে জিজ্ঞাসা। লেখক, পাঠক, প্রকাশক চ্যালেঞ্জ কাঁধে নিয়ে কাটিয়েছেন প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা; ধুপধুপানি বহন করে যার যার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন মেলায় টিকে থাকতে। বইমেলা যে উৎসব তা উদ্যাপন করতে। জোর করে হাসা যায় বটে, তবে সে মেকি হাসি ধরা পড়ে যায় ক্ষণিক পরে। তবে কি এ বছরের বইমেলা কেবলই হতাশার?

বইমেলার ইতিহাসে এ বছরটির বিষাদ-চিহ্ন হয়ে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ৩০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে আসা এই বইমেলাকে এমন বাস্তবতা আর হযবরল-এর মুখোমুখি হতে হবে কে জানত। এই জানাটা অবশ্য অনেক কিছু পরিষ্কার করেছে। লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অনেক রুঢ় বাস্তবতা। শুধু অংশী না, আয়োজকদের জন্যও এ-বছরের বইমেলা এক শিক্ষণীয় অধ্যায়। বইমেলা আসবে, বইমেলা যাবে প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে শিক্ষা না নিলে এমন পরিস্থিতিতে ঠকতে হবে ঘুরেফিরে বহুবার। একটা সময় হয়তো মানুষ তার মুখ ফিরিয়ে নেবে। তখন কি আমও যাবে, ছালাও যাবে না?

ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চ! মেনে নিয়েছে পাঠক। মারি ও মড়কের রিস্ক নিয়ে হাজিরও হয়েছে। প্রকৃতিও সাহায্য করেছে। আয়োজনও নিখুঁত। মাত্র কয়েকটি হজপজ ভন্ডুল করে দিল অনেক আশার বাতিঘর। একটি শিল্পের ধসকে আরো ধসে নামিয়ে দেওয়া হলো অবিচক্ষণতায়। তাতে কার কি এল গেল জানা যাবে না। অনেক প্রকাশককেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না বছরান্তে। পাঠকও চিনে গেছে বিকল্প পথ। অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে পাঠকের বিরাট অংশ। সাহসে উজান বেয়েছি, বইমেলায় ঘুরে ঘুরে দেখেছি এই চিত্র। তারপরও দাঁড়াতে হবে। হতাশার কালো ছাপ মুছতে হবে। হিসাবের খেরোখাতায় হিসাবটা রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে বিকল্প পথ তৈরি করে। আমরা তো এমনই, এমন করেই তো আমাদের জয়ী হয়ে ওঠতে হয় অনেক পরাজয় পাশে রেখে। মারিকাল যেমন সত্য, এটাও সত্য। কিন্তু যারা উদাসীন, যারা দায়হীন, দায়িত্বহীন আর কতদিন? যে মুখগুলো চোখ মুছতে মুছতে বিদায় নিল মেলা থেকে, নিরাশায় বুঁদবুঁদ করতে করতে পেরিয়ে গেল মেলা মাঠের গেট, তাদের কথা কি ভাবা হবে কোনোভাবে? ভাবলে কী ক্ষতি হবে? দুঃখ কিংবা ব্যথা, হতাশা কিংবা আনন্দ; এসব সঙ্গে নিয়েই কামনা করি, পরের বছরটি আসুক নিরোগে উদ্ভাসিত হয়ে, আবার বিশাল আয়োজনে বসুক অমর একুশে গ্রন্থমেলা, আমাদের প্রাণের বইমেলা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close