সফিকুল আলম

  ০৯ এপ্রিল, ২০২১

একটি শৈল্পিক ব্যবচ্ছেদ

সাহিত্য রচনার প্রেরণার মধ্যে জড়িত থাকে মনের গভীরতম অনুভূতি ও সমাজসচেতন মনোভাব। এ মনোভাবে লেখা আবু হেনা মোরশেদ জামানের ‘অ্যানি গাঙ্গুলি পাখি নয়’ গল্পগ্রন্থটি পড়েছি। বলা যেতে পারে, এক নিঃশ্বাসেই পড়েছি। ভালো লেগেছে। কারণ, সমকালীন সাহিত্যের মতো এতে নেই গতানুগতিক স্যাটায়ারের সাতকাহন বা শাসক-শোষিতের দ্বন্দ্ব অথবা নেই বিধ্বংসী বাস্তবতার সৃষ্টিনাশা রূপ। জীবনের কোন জংশনে এসে ব্যক্তির একাপ্ত কাহিনিগুলো ব্যক্তিকে পেরিয়ে কখন ইতিহাসের দুয়ারে এসে ঠাঁই নেবে তা ব্যক্তি নিজেও জানে না।

যেমন ইঁদুর কপালে মুনিম জানত না, জীবনের সকল দুর্ভাগ্য পেরিয়ে শেষবেলায় তার জীবনেও সুসময়ে বাতাস বইবে। মূলত শিষ্টের জয়, দুষ্টের পরাজয় এ গ্রন্থের টাইটেল গল্প ‘অ্যানি গাঙ্গুলি পাখি নয়’-এর মূল উপজীব্য হলেও গল্পকার বিষয়বস্তু ও ভাষার প্রয়োগশৈলীর কারণে গল্পটিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জীবনধারার ব্যবধান ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। অ্যানির কণ্ঠে যখন আমরা শুনি, ‘খুব কন, মাম তো আসেন না, আর আমার স্টেপ ফাদার চান না আমার সাথে মায়ের দেখা হোক, প্রতি বছর মাম ক্রিস্টমাস গিফট পাঠান, মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক এই।’ তখন এই কষ্ট ও হাহাকার পাঠককে বেদনাহত করে। এ ছাড়া বাংলাদেশি যুবক মুনিমেয় অদ্ভুত সারল্য, পাশ্চাত্য দাম্পত্য-জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা, সম্পর্কের টানাপড়েন, অসৎ মানুষের দাপট এবং সবশেষে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন ইত্যাদি বিষয়গুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে গল্পকার টাইটেল গল্পটিতে বহুমাত্রিকতা আনতে সফল হয়েছেন।

ডাকসাইটে সরকারি কর্মকর্তা আবু হেনা মোরশেদ জামানের প্রথম গল্পগ্রন্থ এটি। সত্তর ও আশির দশকে যখন মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট দূর-কল্পনা, তখনকার পটভূমিতে রচিত প্রতিটি গল্প। এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত রূপকথা, কিন্তু রূপকথা না শীর্ষক গল্পটি সাম্প্রতিক সময়ে রচিত। গল্পটি মূলত ধারণ করেছে একাত্তরের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় প্রয়াত শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলোর করুণ আখ্যান।

সদ্য স্বামীহারা মেয়ে, নাতি টিটন আর ছেলে আনোয়ারকে নিয়ে তৈয়বা বেগমের জীবন সংগ্রামের কাহিনি ফুটে উঠেছে আলোচ্য গল্পে। পাশাপাশি যুদ্ধ চলাকালীন প্রতি মুহূর্তের অনিশ্চিত আশঙ্কাও তাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। কিন্তু হার মানেননি তিনি। দারিদ্র্য, ভয় কিংবা অপত্যস্নেহ কোনোটাই তাকে পরাজিত করতে পারেনি। দেশের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ ফুটে উঠেছে মোস্তফা সাহেবের কথায়, ‘আমি জানি, তুমিও গোপনে আনোয়ার ও তার বন্ধুদের খাবার সাপ্লাই দাও। তুমিও জয়বাংলার লোক।’

গল্পে প্রাসঙ্গিক হয়ে এসেছে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ, পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতকতা আর দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ। বিশেষ করে প্রতিফলিত হয়েছে আবহমান বাংলার নারীসমাজের জীবন-সংগ্রাম, সন্তানস্নেহ, দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের করুণ কাহিনি।

বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ মোস্তাফিজ কারিগর। দাম ২০০ টাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close