নাজমুল হাসান

  ০৯ এপ্রিল, ২০২১

বিপক্ষের সুহৃদ ও বন্ধুরা

১৯৮১ সালের শুরুতে জার্মানি (তখন পশ্চিম) থেকে ফিরে এলাম। থাকতাম পূর্ব রাজাবাজারে। এসে জানতে পারলাম, আমার কয়েক বন্ধু মিলে বের করছে ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘বিপক্ষে’। পত্রিকার নামকরণের কারণে অনেকে কিছুটা বিভ্রান্তির মুখোমুখী হন। আভিধানিক অর্থে বিপক্ষে মানে বিরুদ্ধে। কীসের বিরুদ্ধে? প্রচলিত সাহিত্যরীতি ও ভাবনার নাকি সামাজিক বাস্তবতার? পৃথিবীর যেকোনো দেশের সাহিত্য সময় ও কালের গন্ডির মধ্যে তার সৃজনী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যায়। সময় তাকে মূল্যায়ন করে পরে তা কালোত্তীর্ণ হতে পারল কি না। কিন্তু যৌবনের ধর্ম হচ্ছে অগ্র-পশ্চাৎ না ভাবা। বর্ষার বেগবান নদীর মতো যা দুপাড়ের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে দুর্বার ছুটতে চায় সামনের দিকে। আমাদের অবস্থাও অনেকটা সে রকম। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে অনেকে তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের চেষ্টায় আছে। এর মধ্যে অনেকটা অখ- অবসর। সেটাকে কাজে লাগানো। সত্তর দশকের শুরু থেকে আমাদের লেখালেখি। মূলত ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সাহিত্যের পাতা, সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকাগুলো ছিল আমাদের লক্ষ্য। এর মধ্যে অন্যতম ছিল (দৈনিক বাদে) বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘উত্তরাধিকার’, গাজী শাহাবুদ্দিন সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সন্ধানী’ এবং চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত কিছু লিটল ম্যাগাজিন।

বিপক্ষে সম্পাদনার দায়িত্বে ছিল বন্ধুবর আহমদ বশীর (গল্পকার), আবু সাঈদ জুবেরী (গল্পকার) ও জাহিদ হায়দার (কবি)। প্রকাশনার দায়িত্বে ছিল আমাদের অনুজ বন্ধু মানিক চৌধুরী। পত্রিকাটির মুদ্রণ, বাঁধাই ও ছাপার কাজ চলত শান্তিনগর চৌরাস্তার মোড়ে চৌধুরী প্রিন্টার্সে। অর্থাৎ মানিকের প্রেসে। পাশাপাশি ছিল সকাল-বিকাল আড্ডা।

বিপক্ষের আড্ডায় তরুণ-প্রবীণ অনেক লেখক আসতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন গল্পকার বুলবুল চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসতেন কবি মাহবুব কামরান (প্রয়াত)। কবি মাহবুব সাদিক, মাহবুব হাসান, মাহমুদ শফিক, মোশারফ করিম, ময়মনসিংহ থেকে শামসুল তাবরেজী, কুষ্টিয়া থেকে ইকবাল আজীজ এবং ছড়াকার আবু সালেহ। তারা লিখতেন নিয়মিত। এ তালিকা আরো দীর্ঘ হবে কারণ অনেকের নাম এখন সেভাবে মনে পড়ছে না। বিপক্ষের আড্ডায় আসতেন কবি সমুদ্র গুপ্ত (প্রয়াত)। আরো লিখতেন প্রখ্যাত গল্পকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়সুল হক ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখ।

চৌধুরী প্রিন্টার্সের লাগোয়া দক্ষিণে প্রাচীরঘেরা বাড়িটি ছিল সে সময় জাপানের দূতাবাস। দূতাবাসের উত্তরের সীমানা প্রাচীরের পাশ দিয়ে প্রেসের প্রবেশপথ। গেটের গায়ে লেখা ছিল চৌধুরী প্রিন্টার্সের নাম। হাইডেল বার্গ ট্রেডল মেশিনে চলত ছাপার কাজ। অনুজ বন্ধুদের মধ্যে সরওয়ার কবীর ও গল্পকার সেলিম আহমেদ বিপক্ষের আড্ডায় ও লেখালেখিতে বেশ সক্রিয় ছিল। খুব অল্প বয়সেই সেলিম ব্লাড ক্যানসারে মারা যায়। সেলিমের পিতৃদত্ত নাম ছিল জসিমুদ্দীন। কবি আল মুজাহিদী তার পেননেম দিয়েছিলেন সেলিম। সেলিম থাকত পূর্ব রামপুরায়। আমাদের আরেক বন্ধু নজিবুর রহমান বাবুর বাসা ছিল তার বাসার কাছেই। অনেকে আসত বাবুর বাসায় আড্ডা দিতে। সে আড্ডা একসময় বহুদিন টিকে ছিল। বাবুর ওখানে গেলে প্রায়ই সেলিমের সঙ্গে দেখা হতো। বাবু লেখালেখির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও সে বরাবর সিরিয়াস পাঠক। তার বিদেশি সাহিত্য ও দর্শনের বইয়ের সংগ্রহ ছিল ইর্ষণীয়।

চট্টগ্রাম থেকে বিপক্ষে লেখক তালিকায় অন্যতম ছিল কবি শিশির ভট্টাচার্য, কমল সেনগুপ্ত ও গল্পকার আবসার হাবীব প্রমুখ। আমাদের চট্টগ্রামের আরেক বন্ধু শামীম আহমেদ। নিয়মিত গল্প লিখত। একসময় কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল সে। সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটত। কোনো দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এমনটা হয়েছিল। পরে সে সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড পত্রিকা বের করেছিল। যদিও বেশিদিন তা টিকে থাকেনি। বহু বছর আগেই সে সপরিবারে বিদেশে (সম্ভবত থাইল্যান্ড) চলে যায়।

বিপক্ষ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল আমাদের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামসুল আলম। বাসা ছিল শান্তিবাগে। জাহিদ ও বশীরদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিল। প্রখর যুক্তিবাদী। বিয়ে করেছিল সহপাঠীকে। কিছুকাল মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একটি দেশের স্কুলে বাংলা ভাষায় শিক্ষকতা করেছিল। বহুদিন হলো তার সঙ্গেও যোগাযোগ নেই।

আমাদের আরেক বন্ধু আবেদীন কাদেরের কথা না বললেই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। আমেরিকায় গিয়ে পিএইচডি ও একটি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছে। বর্তমানে অবসরে। থাকে নিউইয়র্কে। আবেদীন কাদের অবিবাহিত। মাঝে সে একবার দেশে এলে দেখা হয়েছিল জাহিদের বাসায়। জাহিদ বনশ্রীতে নিজের বাসা করায় আগে থাকত সিদ্ধেশ্বরীর একটি ভাড়া বাসায়। মনে পড়ে বশীরও এসেছিল সেদিন। পরে একসঙ্গে রাতের আহার করেছিলাম আমরা। ফেসবুকে না থাকায় কাদেরের সঙ্গে সেভাবে আর যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

একসময় হঠাৎ করেই বিপক্ষের প্রকাশনা থেমে যায়। বন্ধ হয়ে যায় চৌধুরী প্রিন্টার্স। বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনের অবধারিত পরিণতির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল বিপক্ষেও। নিরবচ্ছিন্ন মুক্ত সাহিত্যচর্চা ও এর নিয়মিত প্রকাশনা দুটিই বেশ দায়িত্বপূর্ণ এবং দুরূহ কাজ সময়ের নিরিখে। আশির দশকে সদ্য স্বাধীন একটি দেশের সাহিত্য পরিম-লের বিপক্ষে তার স্বল্পকালীন যাত্রাপথে অনেককে এক মঞ্চে আনতে পেরেছিল। আর কতটা সফল হয়েছিল তা সময় নিরূপণ করবে। তবে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস ও আন্তরিকতায় উষ্ণ এবং আলোকিত ছিল বিপক্ষে। তখনকার দুর্বল আর্থসামাজিক কাঠামোর ভেতরে এর চেয়ে বেশি কিছু করাও হয়তো সম্ভব ছিল না। এসব ক্ষেত্রে সব উদ্যোগ সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক ও শাশ্বত, তা মেনে নিতে কুণ্ঠিত না হওয়াই উচিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close