reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৯ এপ্রিল, ২০২১

আশুতোষ ভৌমিক

বর্ণিল কবিতার নক্ষত্রবিতান

সত্তর দশকের কবি আশুতোষ ভৌমিক মারা গেছেন গত ৩ এপ্রিল। কবিতায় তার ছিল বহু বর্ণিল কাজ। তাকে নিয়ে লিখেছেন আমিনুল ইসলাম সেলিম

আশুতোষ ভৌমিকের জীবনের একটাই পরিচয়, একটাই নাম কবি। এর বাইরে ব্যক্তিজীবন নামের যে আধো-আলো আধো-অন্ধকারের অনুচ্চ-রব উপস্থিতি, সেটি তিনি অনেক আগেই খুব কম দামে কবিতার কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। সে জীবন আর ফেরত পাননি, হয়তো পেতেও চাননি কখনো। কবিতার মূল্যবান হীরে-জহরত ভর্তি যে জীবন, এর সম্পূর্ণ উল্টোপথে হাঁটা আরেকটা সত্তাকে হয়তো একই আয়নার পিঠে আত্মলগ্ন ছায়ার মতো ধরে রাখতে ইচ্ছে করেনি তার। হয়তোবা সে জীবন ‘দোয়েলের, ফড়িংয়ের।’ কবির অধরা সে জীবনকে সন্ধান করতে যাওয়া তাই বৃথা চেষ্টা করা ছাড়া আর কী হতে পারে? সুতরাং আশুতোষ ভৌমিকের ব্যক্তিজীবন বলে কোনো কিছুকে আলাদা করার সাহস আমরা পাই না। তার অন্য সবকিছু মূলত কবিজীবনের সঙ্গেই একাত্ম হয়ে গিয়েছিল।

ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে লিখতে শুরু করলেও তার কবিতার প্রথম বই বের হয় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, ১৯৭৪ সালে। সত্তরের দশক ছিল মূলত বিশ শতকের কবিতার জোয়ারের নাম। সে জোয়ারজলের তালে তাল মিলিয়ে, শানিত লেখায় অনেকেই খ্যাতিতালিকার শীর্ষে উঠে গেলেও, আশুতোষ ভৌমিক রয়ে গেলেন সাঁতার অপটু মাছের মতন মাঝনদীতে ভাসমান। জলের কম্পনে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলেও সাঁতরে গিয়ে নিজের প্রাণোচ্ছ্বাস জানাতে হয়তো কুণ্ঠাবোধ করেছিলেন। হয়তো নিজেকে জানান দিতে কিছুটা ব্যর্থই হয়েছেন। এর প্রমাণ আমরা পাই, যখন দেখি তার কবিতার দ্বিতীয় বই বের হতে সময় লাগে ১৪ বছর এবং তৃতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ১৯ বছরে। পরে অবশ্য আরো চারটি বই বেরিয়েছে।

তাহলে পাঠক হিসেবে প্রশ্ন করা যায়, একেকটা বই বের হতে এত সময় লেগেছিল কেন? যেহেতু কবিতাই তার ধ্যানজ্ঞান সারা জীবনের আশ্রয়, সেহেতু আমরা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। কবির মুখোমুখি হয়েছি। এটা সত্য যে, তিনি খুব অল্প লিখেছেন। কিন্তু এর বাইরেও তিনি কিছু কাজ করেছেন। শয্যাশায়ী থাকাকালে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন কয়েকটি চিত্রনাট্যও লিখিত হওয়ার কথা। তবে সেগুলোর অসদ্ব্যাবহার হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। তরুণ বয়সে নাটক লিখেছেন, অভিনয়ও করেছেন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। কিন্তু থিতু হলেন কবিতাতেই। আশ্চর্য হই, তাবৎ শিল্পের মধ্যে একমাত্র কবিতারই চর্চা করে গেছেন তিনি। শিক্ষকতা, চিত্রনাট্য, নাটক বা অন্য কিছুই ধরে রাখতে পারেননি। সে হিসেবে আশুতোষ ভৌমিক একজন আপাদমস্তক কবি।

তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ঝড়বাদলের দিনের গল্প, স্বপ্নেরা দ্যাখে স্বপ্ন, সূর্যাস্ত দিনের বাঁকে, নদী কিংবা বালুচর, একফোঁটা ফোটা ফুল তাবৎ ধরিত্রী, ধূসরিমা পাখি হয় পাখিরা আকাশ এবং চরণামৃত। সুদীর্ঘ সময় ধরে বিন্যাস নামে একটি ছোট কাগজ অনিয়মিতভাবে সম্পাদনা করতেন তিনি।

কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে আশুতোষ ছিলেন ঘোরগ্রস্ত, ভাবুক, গোপন রতœবৎ শব্দভান্ডারের শৌখিন মালিক, অনাবিষ্কৃত সুন্দরের পূজারি। স্থায়ী অনুরণন তৈরি করা নতুন শব্দ তথা নিজস্ব শব্দসমষ্টির স্রষ্টা হিসেবেও অনন্য তিনি। তার কবিতা পাঠককে আনন্দ দিয়েই দায়মুক্ত হয় না, বরং পাঠকহৃদয়ে ঘোরতর ভাবনার মোচড় তৈরি করে, রহস্য ময়তায় আবিষ্ট করে। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দমালা যেন সমুদ্রপাড়ের ঝলমলে মুক্তোদানা। ভাষাভঙ্গিমা, আঙ্গিক ও ভাবের স্ফুরণে তার কবিতা স্বকীয় এবং দুপুরের রোদের মতন উজ্জ্বল।

শিল্পতৃষ্ণার ভেতরে জীবনতৃষ্ণাকে লুকিয়ে ফেলে বাংলা সাহিত্যে যারা ‘শুদ্ধতম কবিতার কবি’ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন, অন্তত সাধক হিসেবে তাদের একজন তিনিও। তার নির্মিত কবিতাভুবন জীবনবোধের নানামাত্রিক উপাচারের এক অত্যাশ্চর্য প্রাণভূমি। গুমোট বাতাসের কণ্ঠে ধ্বনিত ব্যথিত মানুষের হাহাকার তার কবিতা তুলে এনেছে গভীর মমতা, অপরিসীম প্রেম আর সযতœ মহিমায়। কবি হিসেবে তিনি অস্থির বা নিরুদ্দিষ্ট না হলে আশি বা নব্বইয়ের দশকে এসে স্বনির্মিত কবিতাভুবন তাকে পরিচয় করিয়ে দিত নতুন দিগন্তের উন্মোচক হিসেবে। সেটা হয়নি বলে তার কবিতা খুব বেশিসংখ্যক পাঠকস্পর্শ পায়নি।

অন্তর্নিহিত বোধের গভীরতা, স্বকীয় ভাব ও ভাষাপ্রকরণ, শব্দ নির্মাণ ও প্রয়োগকুশলতা, ইঙ্গিতবহ উপমা-উৎপ্রেক্ষার সাবলীল প্রয়োগ তার কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। নানা অসংগতির বিরুদ্ধে তার কবিতা যেমন মৃদু সোচ্চার, যাপিত জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গও তেমন উঠে এসেছে। কবিতায় এসেছে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, রাজনীতি এমনকি ধর্মের অপব্যাখ্যার কারণে সামাজিক বিভাজনের কথাও। তার কবিতা কেবল শব্দের সুদৃশ্য মালা নয়, খ-িত ভাবের অসংলগ্ন উচ্চারণ কিংবা কাহিনিসর্বস্ব সাধারণ বার্তা নয়। তার রচিত কবিতার প্রতিটা শব্দই সুনির্বাচিত, অর্থগত ও ভাবগত বিবেচনায় সুনিয়ন্ত্রিতও। বলেছিলাম যে, কবি নতুন কিছু শব্দের স্রষ্টা। উদাহরণ দেওয়া যাক: পূর্ণিমাজল, পূর্ণিমারোদ, জোছনাবলি, চন্দ্রালোচ্ছ্বাস, পূর্ণিবান, নৈঋতবন্দর, অমানিশাবন, নক্ষত্রবিতান, নিঃসঙ্গজট, চন্দ্রসম্প্রপাত। এ রকম উল্লেখযোগ্য ভাবোদ্বেল শব্দের স্রষ্টা তিনি।

কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে তিনি প্রায় কোনো রকম রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রশ্রয় দেননি, কোনো রাজনৈতিক গ-ির ছায়াও আশা করেননি। ছিলেন ধ্যানমগ্ন, একা। এই একাকিত্ব তার পুরো জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। কবি জানতেন, শূন্যতাই জীবনের পরিণতি। সেজন্যই বোধহয় কবিতায় শূন্যতার বহুমাত্রিক ছবি আঁকতে চেষ্টা করেছেন।

আশুতোষ ভৌমিক একাত্তরে একজন যোদ্ধাও ছিলেন। অথচ দেশের জন্য যুদ্ধ করে বিনিময় নেওয়ার ভাবনা তার কাছে মূল্য পায়নি। একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক না হলে এমন করে ভাবা যেত না। আশুতোষকে সত্তরের দশকের কবি বলে চিহ্নিত করলেও তিনি কেবল সত্তরের দশকে বন্দি ছিলেন না। নব্বই ছাড়া আর সব দশকে তার প্রায় সমান বিচরণ ছিল। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসেও আমরা তার যে তারুণ্য দেখেছি কাশশুভ্র চুলের পেখমে, যেমন দেখেছি তার সরল হাসিতে, আমাদের কাছে তিনি ছিলেন এক জীবন্ত কবিতা, কবিতার বর্ণিল নক্ষত্রবিতান। মননশীল পাঠকের কাছে আশুতোষ ভৌমিকের কবিতাপাঠ অনিবার্য হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close