ইলিয়াস ফারুকী
গল্প
ভালোবাসার বায়বীয়াকার
হেমন্তের বিকাল আর পাকা কলার ছাল, এ দুটোর সঙ্গে হায়াৎ-এর সূক্ষ্ম একটা সম্পর্ক রয়েছে। একটা বন্ধু, অন্যটা শত্রু। হেমন্তের বিকাল যেমন হায়াৎ-এর জন্য দুষ্প্রাপ্য ইউরেনিয়াম, অথচ সামান্য পাকা কলার ছাল তার জীবন থেকে ছিনিয়ে নেয় অমূল্য সম্পদ তার ভালোবাসার সোনামুখী সুচ।
সেদিনটাও ছিল হেমন্তের বিকাল। সময়টা ছিল শীতের চাদর জড়ানো রোদের আসর। ছিল দারুণ একটা ভালো লাগা, ভালো লাগা ভাব। যেন সরিষার তেল মাখানো ভাতের সঙ্গে কাঁচা-পাকা টমেটোর সালাদ। সময়টা উপভোগ করতে করতে হায়াৎ আপন মনে বিড়বিড় করছিল। এই শীতে নাকি করোনার প্রকোপ বেড়ে যাবে। সরকারিভাবে সবাইকে সাবধান করা হচ্ছে। মাস্ক পরিধানের ওপর খুব বেশি জোর দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাস্ক না থাকায় অনেককে জরিমানাও গুনতে হয়েছে। অথচ হায়াৎ যেন তখন আধ্যাত্মিক জগতের বাসিন্দা। কড়াকড়িতে তার কিছুই আসে যায় না। করোনাকে যেন সে আহ্বান করছে তার সঙ্গে সখ্য গড়তে। সে মাস্কের ধারও ধারে না। কারণ ওর জীবনটাই যে এখন মাস্কহীন হয়ে গেছে। ভিমের গদার মতো ওর জীবন এখন মস্ত ভার হয়ে আছে। হায়াৎ-এর কাছে বিকালটাই শুধু ওর আপন, বাকি সবটা শূন্য।
শীতের বিকালে সময় কাটানো এবং পরিবেশ উপভোগ করা তার অনেক দিনের অভ্যাস। এতে তার আনন্দের মাত্রা অনেক গুণ বেড়ে যেত। বিকালটাকে আপন করে পাওয়ার জন্য কেউ তাকে দমিয়ে রাখতে পারত না। প্রতিদিনের মতো সেদিনও হাঁটতে হাঁটতে তার বিগত শীতের বিকাল মনে পড়ে যায়। গত শীত এবং তারও আগে আরো অনেক শীতের বিকাল ছিল মধুর ঝঙ্কারে রাঙানো। হৈমন্তী সঙ্গে থেকে তার মধুরতা ছড়িয়ে বিকালটা আরো আনন্দময় করে তুলত। টোস্টে যেমন মাখন জ্যাম জেলি। শীতের বিকালে তেমনি হায়াৎ, রথী ও হৈমন্তী।
গত এক বছর রথী ও হৈমন্তী নেই। নদীতে যেমন প্রবাহের সঙ্গে ভেসে যায় বিভিন্ন বস্তু। সেই সঙ্গে ভেসে যায় মানুষের স্বপ্ন। তেমনি ভেসে গেছে হায়াৎ-এর জীবনের সব আনন্দ। সময় তাকে নিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতের অজানা বন্দরের কাছে। তার নিজেকে মনে হয় আস্ত একটা মাকাল ফল। ওপরে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি, ভেতরে কর্কটে পরিপূর্ণ। মাঝেমধ্যে রথী আর হৈমন্তীর ওপরে তার ভীষণ অভিমান হয়। কী করে পারল ওরা ওকে একা ফেলে যেতে। বিশেষ করে হৈমন্তীর শেষ দিনটা তাকে এখনো উতলা করে তোলে।
রথীর কষ্টেরাও ডুকরে উঠত থেকে থেকে। কুমিরের অশ্রু থাকে না, তাই বলে কি কুমিরের কষ্ট নেই। মুখের শিকার ছুটে গেলে কুমিরেরও কষ্ট হয়। রথীও তেমনি হয়ে গিয়েছিল। রথীর চোখে কেউ কোনো দিন কষ্টের জল দেখেনি। তাই বলে কি তার কষ্ট নেই। তার কষ্ট ঢেকে ছিল হায়াৎ-এর ভালোবাসার চাদরে। একটি পাকা কলার ছাল এবং তার প্রথম সন্তান গর্ভেই নষ্ট হওয়ার ব্যথা এবং ডাক্তার যখন বলল, রথী আর কোনো দিন মা হতে পারবে না এই ব্যথা। পাঁচ মাসের গর্ভবতী রথীর পা পড়েছিল অসচেতনভাবে রাস্তায় ফেলে রাখা কলার ছালের ওপর। আর তাতেই তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। দুই ব্যথা মিলে যেন অ্যাসিড হয়ে গিয়েছিল। হৃদয়ের ব্যথা হৃদয়ে সয়ে গেলেও চেহারাকে রঙিন বাতি শোভিত সাইনবোর্ড বানিয়ে রেখেছিল সে।
হেমন্তের এক বিকালে তার অতিপরিচিত চটপটির দোকান ওদের জীবনে আবার আনন্দে ভরে দিয়েছিল। ওরা বলতে হায়াৎ আর রথী। অ্যাক্সিডেন্টে গর্ভের সন্তান হারানোর পর মন ভালো রাখার জন্য হায়াৎ সময় পেলেই রথীকে বেড়াতে নিয়ে যেত। এমনই এক দিন, চটপটির দোকানে হঠাৎ কোত্থেকে তিন বছরের এক শিশুকন্যা এসে হাজির। হায়াৎ ও রথী খাওয়ায় মনোযোগী ছিল। হঠাৎ রথী টের পেল কে যেন পেছন থেকে শাড়ির আঁচল টানছে। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পায় ছোট তিন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। নোংড়া পরিধান অথচ মায়াময় দৃষ্টি ‘আমালে দিবা’ তোতলাতে তোতলাতে ছোট হাতটা বাড়িয়ে দেয়। স্তব্ধ হয়ে যায় রথী। অনুভূতিতে জেগে উঠে ঘুমন্ত মমতা। হাঁটু গেড়ে বাচ্চাটার সামনে বসে পড়ে রথী। তার ভেতরের শূন্যতা তার মাতৃত্বকেও উচকে দেয়। চোখ দিয়ে অনবরত ঝরে পড়তে থাকে নীরব অশ্রুর ধারা। কোনো রকমে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার সঙ্গে কে আছে’ শিশুটি দুই হাত উল্টে বলল, ‘তেউ নাই তেউ নাই, আমার তেউ নাই’। রথী আবার জানতে চায়, ‘তুমি কোথায় থাকো’? কিন্তু শিশুটি উত্তর দিতে পারে না। নিজের পেটের ওপর হাত রেখে শুধায় ‘খিদা খিদা’। খিদের তাড়না তার চোখে পানি হয়ে ঝরে। নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না রথী, ঝট করে শিশুটাকে কোলে তুলে নেয়। হায়াৎ-এর অস্তিত্ব ভুলে অনেকটা পাগলের মতো পাশের একটা ফাস্টফুডের দোকানে গিয়ে প্রবেশ করে। বাচ্চাটার জন্য খাওয়ার অর্ডার করে নিজের হাতে খাওয়ায়। খাওয়া শেষ করে বাচ্চাটা অনেকক্ষণ রথীর পানে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘তুমি কী আমার আম্মু লাগো। জানো, কতজনের কাছে খাওয়া চাইলাম, কেউ দিল না। কেউ কেউ মার দিল, আম্মুরাই তো এভাবে খাওয়ায়, বুঝেছি, তুমিই আমার আম্মু।’ বলেই রথীকে জাপটে ধরে। নিজেকে সামাল দিতে ব্যর্থ হয় রথী। তার কান্নার শব্দে ফাস্টফুডের দোকানের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। উপস্থিত অনেকেই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রথী সন্তান পায় আর হৈমন্তী মা। হৈমন্তী নামটাও রথীরই দেওয়া। হেমন্তের পাওয়াটা হৈমন্তী আকারে তার মাতৃত্বকে পূর্ণ করে দেয়। পিতৃত্বের অতৃপ্ততা গোছাতে যেন কোনো সমস্যা না হয় তাই আইনের দিকগুলো হায়াৎ ঠিক করে নিয়েছিল।
হৈমন্তী ওদের দিনগুলোকে মধুময় করে তুলেছিল। কিন্তু ভালোবাসার নৌকা যে অথৈ ঢেউয়ে ঠিক থাকতে পারে না। ওতে দোল লাগে। আর ভীষণ দোল সব ওলট-পালট করে দেয়। দোলটা এলো হৈমন্তীর বয়স যখন ১০ বছরে। করোনা নামে এই দোল হায়াৎ ও রথীর জীবনকে আবার এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল।
ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া যেমন ঝরে পড়ে যায়, হৈমন্তীও ঝরে গেল অকালে। হৈমন্তীর শোক শজারুর কাঁটা হয়ে ফুটল রথীর জীবনে। হারানোর অসহ্য বেদনা জীবন থেকে তাকেও ছুটি দিয়ে গেল।
হায়াৎ এখনো নিয়মিত বিকালের রোদে স্নান করে। শীত, গ্রীষ্ম এখন নিমিত্তমাত্র। সারা দিনের ক্লান্তির পর এই সময়টিতে সে তার হৈমন্তী ও রথীকে খুঁজে পায়। সন্ধ্যা হতেই ওরা তিনজনেই এক হয়ে মিলিয়ে যায় অজান্তে, যেখানে সুখ-দুঃখের বোধ অকার্যকর।
"