কাজী লাবণ্য

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২১

গল্প

শতভিষা

মাআ! বিকালে খেলতে যাব কিন্তু। বলতে বলতে স্কুল ইউনিফর্মের জামা একদিকে, ওড়না আরেকদিকে, জুতা-মোজা দুদ্দাড় ছুড়ে মারতে লাগল। ঘেরা বারান্দায় টেবিলে সরপোষ দিয়ে ঢাকা খাবার টেনে নিয়ে নাকেমুখে গুঁজতে থাকে। স্কুলে পরীক্ষা চলছে বলে গত দু-তিন সপ্তাহ খেলতে যাওয়া হয়নি। আর মাত্র একটি পরীক্ষা বাকি, ধর্ম। তার আগে শুক্র ও শনিবার ছুটি। ওর মনে হয় ধর্ম পরীক্ষার আগে দুদিন ছুটির কোনো মানে হয়!

আস্তে খা রে বাবা, গলায় আটকাবে। হাত-মুখটাও ভালোভাবে ধুসনি। খেলতে যেতে যে চাচ্ছিস, এখনো তো একটা পরীক্ষা বাকি।

মা, দুদিন লম্বা ছুটি আছে। আর ভারী তো এক পরীক্ষা এক দিন পড়লেই হয়ে যাবে। আজ সব্বাই খেলতে আসবে। তুমি চিন্তা করো আমরা কত দিন খেলিনি। ওর হায় আফসোসে বাইরের শজনেগাছের ডালের চড়–ইগুলোও চিড়িক চিড়িক ডেকে ওঠে।

আচ্ছা বাবা যাস। যা একটু রেস্ট নে। বেলা পড়ে আসুক।

মেয়ে ঘরে গেলে মা টেবিল গুছিয়ে রেখে রান্নাঘরে যায়। বিকালের চা-নাশতার ব্যবস্থা করতে হবে। কী করবে তাই নিয়ে ভাবছে, প্রতিদিন সকাল-বিকাল এটা একটা ভয়াবহ জটিল ভাবনা। হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটা টমেটো সস দিয়ে সবজি পাকোড়া পছন্দ করে। ওর বাবাও আগ্রহ করে খায়। ফ্রিজ থেকে সব সবজি কিছু কিছু করে নিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলল। একটা ম্যাগি নুডলসের প্যাকেট সেদ্ধ করে ওর মধ্য দিয়ে সব মসলা দিয়ে মেখে নিল।

পাটে বসার আগে সূর্যটা সোনালি রং মাখাচ্ছে প্রকৃতিতে। ওর বাবা এখুনি ফিরবে, পাকোড়া ভেজে ফেললেই হয়। হঠাৎ মনে হলো, মেয়ের কোনো সাড়া নেই কেন! না বলে তো খেলতে যাবে না। প্যানে তেল ঢেলে আবার কি মনে করে চুলা নিভিয়ে ঘরে আসে। ঘরে মেয়ে নেই। মাঝের দরজা দিয়ে মেয়ের ঘরে যায়, না নেই। আজব গেল কোথায়!

বাথরুমের দরজা চাপানো। খেলতে যাওয়ার কথা, সন্ধ্যা হয়ে এলো অথচ সাড়া নেই! দরজায় টোকা দিয়ে

কিরে তুই না খেলতে যাবি! মেয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মা চমকে ওঠে।

কী হয়েছে? মা, কী হয়েছে মা? বলতে বলতে কাছে আসে। মেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ওর শরীর কাঁপছে। মা হতভম্ব হয়ে যায়। মেয়ের হলো কী? বারবার জিজ্ঞেস করাতে সে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে থাকা ওর প্যান্ট, স্কার্টের দিকে আঙুল তোলে।

মা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। মেয়েটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। এরপর মেয়ের হাত-মুখ ধুয়ে দিয়ে ঘরে বসিয়ে বাথরুমে গিয়ে মেয়ের কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে এসে ওর কাছে বসে। সে একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে।

মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আস্তে আস্তে সব খুলে বলে।

মেয়েরা বড় হলে মানে একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছালে সবার এ রকম হয়। একে সাধারণত মাসিক বলা হয়। প্রতি মাসে হয় তাই হয়তো এমন বলে থাকে।

মেয়ে আঁতকে ওঠে।

প্রতি মাসে! প্রতি মাসে আমার এসব হবে! বলেই আবার কান্না...

মাসিক কোনো রোগ নয় মা। এটি প্রতিটি মেয়ের জীবনচক্রের একটা অংশ। কাজেই ভয় না পেয়ে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। তবে সচেতন হতে হবে, কিছু জিনিস শিখতে হবে। মাসিক নিয়ে বহু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। আর সেসব ভুলের কারণে একটি মেয়ের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিও হতে পারে। বাবা কিংবা মা যদি একটি নির্দিষ্ট বয়সে বা মাসিক হওয়ার পর মেয়েদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করে, তাহলে ব্যাপারটা সহজ ও স্বস্তিদায়ক হয়। মাসিকের সময় কারো কারো প্রচ- পেটব্যথা হতে পারে। তখন চিকিৎসকের পরামর্শও নিতে হয়, বুঝলি!

মাসিক একজন নারীকে অন্য একটা প্রাণের জন্ম দেওয়ার জন্য তৈরি করে, এটা তার জন্য নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়। কাজেই পরিবারের সবার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তাতে লজ্জার কিচ্ছু নেই।

চল মা, তোকে কাপড় নেওয়া শিখিয়ে দিই। পরে তোর বাবাকে দিয়ে প্যাড আনিয়ে নেব।

না, না, তুমি কিছুতেই এসব কথা বাবাকে বলবে না।

বোকা মেয়ে! এতক্ষণ কী বোঝালাম তোকে! বাড়ির সবাই মিলে আলোচনা করা যাবে এ নিয়ে। আমারই ভুল হয়েছে তোকে আগে থেকেই একটু একটু করে বলা লাগত।

মেয়ের কোমরে একটা ফিতা বেঁধে পরিষ্কার নরম শাড়ির আঁচল ভাঁজ করে পরিয়ে দিল। মেয়ের চোখের জল বন্ধ হয় না। সে নিজের ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল।

দুই.

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর রাফিয়ার বাবা ওর মাকে জিজ্ঞেস করল

ওর কী হয়েছে বলো তো। ওকে তো কোনো দিন এভাবে দেখিনি। তুমি মানা করাতে কিছু জিজ্ঞেসও করলাম না।

মা সব কথা খুলে বললেন। রাফিয়ার বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন।

ওহ্। আমার মেয়েটি তবে বড় গয়ে গেল গো! এই তো সেদিন জন্ম...

দেখো, মাত্র ১৩ বছরে কি আর সত্যিই বড় হয়! এটি একটি শারীরিক প্রক্রিয়া, যার পথচলা শুরু হলো মাত্র। তবে এরা সময়ের সুফলভোগী। আজ আমি ওকে সব খুলে বললাম, ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করলাম। কাল দেখি মার্কেট থেকে ওর জন্য প্যাড আর প্যান্টি নিয়ে আসব।

হ্যাঁ যা যা লাগে নিয়ে এসো।

অথচ দেখো, আমি নিজে কিন্তু এত সুযোগ-সুবিধা দূরের কথা, স্বাভাবিক আবহটুকুও পাইনি। আমার যখুনি শুরু হতো, আমার দাদিবাড়িতে কড়া আইন জারি করত

‘এই মাইয়া ঘর থন য্যান বাইর না হয়। ঘুম থেইকা উইঠা আগে গোসল করব, আর ঐসব নাপাক ন্যাকড়া গোসলখানার পেছনের বেড়ার গায়ে শুকাইতে দিব’। মা অশান্তি এড়াতে জবাব দিত

আচ্ছা মা, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব দেখছি।

হ, তুমি যে কি দ্যাকপা আমার জানা আছে। আমাকেই দ্যাকতে হইব। এসব পাক-নাপাক, গুনাহের কাম আমার চক্ষের সামনে চইলবে না বৌমা, এই আমি তোমারে কইয়া দিচ্ছি।

আচ্ছা মা।

কী যে দুর্বিষহ দিন গেছে কী বলব তোমাকে। অথচ এই বুড়ি আমাকে ভীষণ আদর করত, প্রথম নাতনি বলে আমি ছিলাম তার চোখের মণি, কিন্তু মাসের ওই কটা দিন আমার ওপর রোলার চালাত। স্কুলে যেতে দিত না, খেলতে যেতে দিত না, এমনকি খাবার সময়েও বাইরে আসতে দিত না। চুল খোলা রাখা যাবে না, চুলে তেল দেওয়া যাবে না, বইপড়া যাবে না, মাছ-মাংস খাওয়া যাবে না ইত্যাদি। যত দিন বেঁচে ছিল, বুড়ির খাসলত বদলায়নি।

তবে সময় বদলে গেছে। সেসব কুসংস্কার দূরে গেছে। জীবন অনেক সহজ হয়েছে। হাইজিন বলে যে একটি ব্যাপার আছে, সেটা আজ অনেকেই অনুশীলন করছে।

মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক প্রচার-প্রসারতা মানুষকে আজ সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে।

তুমি ঠিক বলেছো। আসলেই মেয়েদের জীবনে কঠিন জার্নির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রতি মাসে এমন একটি ব্যাপার সামাল দেওয়া কি মুখের কথা! তার মধ্যে নিত্য কাজকর্ম, লেখাপড়া, অফিস করা সবই তো করতে হয়। আহারে!

হ্যাঁ। আজ নিজের মেয়ে বলে তুমি ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারছো। যাক তবু তো পারছো, সবার পারা উচিত... কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়ে ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে, ছলছল চোখে বাবা-মায়ের দিকে আসতে আসতে আবার থেমে যায়। ওর বাবা দ্রুত ডেকে ওঠে

আয় মা আয়, আমার কাছে আয় তো। মেয়ে আর্তচোখে একবার বাবার দিকে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে

আজ আমি তোমাদের সঙ্গে ঘুমাই?

বাবা-মা দুজনে একসঙ্গে বলে ওঠে হ্যাঁ মা কেন নয়! আয় আয়।

খাটে আড়াআড়ি তিনজনে শুয়েছে। মাঝখানে মেয়ে দুই পাশে আস্থার দুই মানুষ। বাবা-মা। মেয়েটার আর ভয় করে না। মন খারাপ লাগে না, কান্নাও পায় না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close