নূর কামরুন নাহার

  ০৮ জানুয়ারি, ২০২১

রাবেয়া খাতুন : স্বতন্ত্র পথের যাত্রী

বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নাম রাবেয়া খাতুন। নিরন্তর সংগ্রাম, একনিষ্ঠ সাহিত্যে সাধনা তাকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে যখন ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য বিকশিত হতে চলেছে একটা নতুন বোধ ও নতুন শক্তি নিয়ে, ঠিক তখনই তিনি শুরু করেন সাহিত্যজীবনের এই দীর্ঘযাত্রা। সে সময়টায় একজন নারীর সাহিত্যচর্চা খুব সাধারণ ও সহজ বিষয় ছিল না। মেয়েদের জীবন তখনো অনেকটাই চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

‘রাবুর হাতের লেখা পত্রিকা অফিসের পরপুরুষেরা দেখে, এজন্য আমাকে গঞ্জনা সহিতে হয়’ এ রকম চিঠিও এসেছিল রাবেয়া খাতুনের বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে। কিন্তু এসব বাধা আর সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সাহিত্যের প্রতি নিবেদন ও কলমের শক্তিতে তিনি শামিল হতে পেরেছিলেন সাহিত্যের তীর্থযাত্রী শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গাফ্?ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান, জাহানারা ইমাম, রিজিয়া রহমান প্রমুখ লেখকের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে যেমন ছিল তার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা, তেমনি সমানতালে তিনি লিখেছেন এই সহযাত্রীদের সঙ্গে, সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করছেন আপন সৃষ্টি-প্রতিভায়।

রাবেয়া খাতুনের লেখালেখি শুরু শৈশবে। লেখার হাতেখড়ি উপন্যাস দিয়ে। ‘আমার লেখার হাতেখড়ি হয় উপন্যাস দিয়ে, ঢাউস ঢাউস উপন্যাস। বাড়ির নিয়ম ছিল সপ্তাহে দুটো বায়োস্কোপ বা টকি সিনেমা দেখা। আমার কাহিনি তৈরি হতো সম্ভবত সেই মাল-মসলায়।’

প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘মধুমতী’তেই তিনি দাগ কেটেছিলেন। তৈরি করেছিলেন একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের। অনেকগুলো চরিত্র নিয়ে বিস্তৃত ক্যানভাসের মধুমতি উপন্যাসটি পরে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া হয়। সাহিত্যের নানা শাখায় তার স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ। লিখেছেন নানা বিষয় নিয়ে। উপন্যাস লিখেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি, ছোটগল্পের সংখ্যা চারশোরও অধিক, ছোটদের জন্য লিখেছেন প্রচুর। বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্যের একজন অন্যতম লেখক তিনি। অসংখ্য দেশ ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ছিল তার। সেগুলোই তুলে এনেছিলেন কলমে। ‘হে বিদেশী ভোর’, ‘মোহময়ী ব্যাংকক’, ‘টেমস থেকে নায়েগ্রা, ‘কুমারী মাটির দেশে’, ‘কিছু দিনের কানাডা’, ‘চেরি ফোটার দিনে জাপানে’, ‘মমি উপত্যকা’ এবং ‘অন্যান্য আলোকিত নগর’ তার উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ রচনা।

তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন পুরান ঢাকার মানুষ ও জীবনকে। জীবনের সেই অভিজ্ঞতা আর নিবিড় পর্যবেক্ষণে পুরান ঢাকার জীবন ও ঐতিহ্যকে দক্ষহাতে তুলে এনেছেন ‘রাজাবাগ’, ‘বায়ান্নো গলির এক গলি’ কিংবা ‘সাহেববাজার’ প্রভৃতি উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধ তার চেতনায় ভাস্বর। তার লেখার একটা বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। তার গল্প-উপন্যাসে বারবার এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, এসেছে ভাষা আন্দোলন। তাই ‘প্রথম বধ্যভূমি’ উপন্যাস লেখেন ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে। ‘ফেরারী সূর্য, ‘হিরণ দাহ’, ‘বাগানের নাম মালনিছড়া’, ‘হানিফের ঘোড়া’ লেখেন মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলো নিয়ে। শিশুদের জন্য লেখা ‘একাত্তরের নিশান’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত ‘তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা’ ‘ঈশা খাঁ’ সর্বমহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার এই ব্যাপক লেখালেখির পরও তৃপ্ত হতে পারেননি তিনি। সৃষ্টির তৃষ্ণা তাকে তাড়িয়ে ফিরেছে।

সমকালীন জীবন এবং সাম্প্রতিক জীবনধারাকেও তিনি তুলে এনেছেন নিবিড় পর্যবেক্ষণে। ‘ঠিকানা বি এইচ টাওয়ার’, ‘কুয়াশায় ঢাকা নগর বধূ, ‘রমনা পার্কের পাঁচ বন্ধু’ ইত্যাদি উপন্যাস নগরজীবনের যন্ত্রণা, যুগসংকট, আধুনিক মানুষের স্বপ্ন, দ্বন্দ্ব ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার মূর্তপ্রতীক হয়ে উঠেছে। তার লেখা কাহিনি নিয়ে চারটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। প্রথম চলচ্চিত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম কিশোর চলচ্চিত্র। ১৯৬৪ সালে এটি নির্মিত হয়। ২০০৪ সালে চলচ্চিত্রে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘মেঘের পর মেঘ’। ছবিটি একাধিক পুরস্কার পায়। ‘কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি’ মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। এরপর ২০০৫-এ মুক্তি পায় ‘ধ্রুবতারা’।

লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন। বাংলা একাডেমির কাউন্সিল মেম্বার, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের বিচারকসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, বিজনেস ও প্রফেশনাল উইমেন্স ক্লাব, মহিলা সমিতিসহ নানা সংগঠনের সঙ্গে। লেখক জীবনে ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে একুশে পদক, ২০১৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, ১৯৯৬ সালে জসীমউদদীন পুরস্কার, শেরেবাংলা স্বর্ণপদকসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

জীবনকে এবং তার চারপাশকে রাবেয়া খাতুন উপলব্ধি ও প্রকাশ করছেন ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্যিকের অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা। মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ গন্ডি ও প্রথাগত চিন্তার গন্ডি থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পেরেছেন আর নির্মাণ করতে পেরেছেন তার স্বতন্ত্র পথ। অসীম সাহসের সঙ্গে রাবেয়া খাতুন পথ চলেছেন আত্মশক্তি দ্বারা, তাই তার কলম কখনো থামাতে হয়নি। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন আধুনিক মানুষ। যেমন তিনি জীবনে সংগ্রাম করেছেন, তেমনি জীবনকে উপভোগও করেছেন বহুমাত্রিকতায়। নানাভাবে জীবনকে বাজিয়ে দেখেছেন। সেই রক্ষণশীল পরিবেশের জীবন থেকে দেখেছেন আধুনিক জীবনের উত্তরণ।

রাবেয়া খাতুনের সৃষ্টি সম্ভার ব্যাপক। নাটক চলচ্চিত্রায়নও প্রচুর। সাহিত্যের নানা শাখায় তার বিচরণ। নানা শ্রেণির মানুষ নানা দেশের মানুষের সঙ্গে তার জানাশোনা। সব মিলিয়ে এক অনন্য সৃষ্টিশীল ও অসম্ভব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। তবে তার এই ব্যাপক সৃষ্টির জগৎ নিয়ে তিনি সেভাবে আলোচিত হয়ে ওঠেননি। কোথাও তার একটা পাঠকবিচ্ছিন্নতা রয়ে গেছে। তার এই বিপুল সৃষ্টির জগৎ নিঃসন্দেহে আরো বেশি আলোচনার চাবি রাখে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close