মিনহাজ উদ্দীন শরীফ
সাপের বাড়ি নেমন্তন্ন
অনেক দিন আগের কথা, এক জঙ্গলে বাস করত সাপ ও ব্যাঙ। সাপ আর ব্যাঙের মধ্যে ছিল খুব ভাব। সাপ ও ব্যাঙের বন্ধুত্ব দেখে জঙ্গলের পশুপাখিরা বিস্মিত হয়ে গেল। তারা বলল, ‘যুগ যুগে ধরে দেখে আসছি সাপ ব্যাঙ খায়। এখন দেখা যায় সাপ আর ব্যাঙের বন্ধুত্বও হয়।
এক দিন ব্যাঙ ডোবাতে ঘ্যাঙরঘ্যাঙ সুরে ডাকছিল। তার ডাক শুনে শিয়াল কাছে গিয়ে বলল, ‘কি ব্যাঙ ভায়া মনে হয় বড্ড হাসিখুশিতেই আছো’? সে বলে, ‘তা-আর কী বলতে হয়। গলা দিয়ে গান কী এমনি এমনি চলে আসে? যখন কেউ সুখের মুখ দেখে তখনই গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে হয়। যেমন এখন আমি, এজন্যই গান গাইছি। শিয়াল বলল, ‘বাহ! ব্যাঙ ভায়া তুমি তো দেখি আজকাল খুব মিষ্টি করে কথা বলতে পারো। তা, কীসের জন্য এত হাসিখুশি জানতে পারি? ব্যাঙ বলল, আমার পূর্বপুরুষরাও কখনো সাপের বাড়ির নেমন্তন্ন পায়নি। যায় আমি পেয়েছি। সাপ বন্ধু তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য আমাকে দীর্ঘদিন ধরে বলছে।’
শিয়াল বলল, ‘ওহ, এই ব্যাপার! তুমি কী জানো তোমার পূর্বপুরুষরা কেন সাপের সঙ্গে মিলামিশা করত না? ব্যাঙ বলল, ‘জানি জানি তারা সবাই ছিল অশিক্ষিত তাই ভালো মন্দ বোঝার তাদের ক্ষমতা ছিল না। সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করে জীবন কাটিয়েছে। শিয়াল বলল, ‘নাহ! তোমার ধারণা একদম ভুল। সাপ তোমাদের চিরকালের শত্রু, তোমাদের খেয়ে সাপের পূর্বপুরুষ জীবন ধারণ করত, যা এখনো এমনটা চলছে। এজন্যই তোমার পূর্বপুরুষ কখনো সাপেদের সঙ্গে মেলামেশা করত না। এক দিন দেখবে তোমাকেও সে আহার করে নিজের ক্ষুধা মেটাবে। ব্যাঙ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘শিয়াল ভায়া বানিয়ে বানিয়ে আর বলতে হবে না। তোমার নিশ্চয়ই আমার আর সাপের বন্ধুত্ব দেখে হিংসা হচ্ছে, এজন্যই তুমি এমন করে বানিয়ে বানিয়ে বলছো। আমার আর সাপের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে।
ব্যাঙ, শিয়ালকে অপমান করতে শুরু করল, শিয়াল যাওয়ার আগে বলল, ‘এক দিন নিজের ভুলের মাশুল নিজেকেই তোমার দিতে হবে।’ সেদিন নিজের জীবনের জন্য বড্ড আফসোস করবে। তখন কিছুই করার থাকবে না। ব্যাঙকে যে আসে সাপের চরিত্র সম্পর্কে বোঝাতে তাকেই ব্যাঙ অপমান করে। একসময় ব্যাঙ এক এক করে জঙ্গলের সব পশুপাখির সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিল। তারপর একা একাই ঘোরাফেরা করত।
এক দিন দুপুরবেলা সাপ-ব্যাঙের বাড়িতে আসল। ব্যাঙ সাপকে দেখে খুব খুশি হয়েছিল। ব্যাঙ সাপকে কোথায় বসতে দেবে এই নিয়ে ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। তখন সাপ বলল, ‘বন্ধু এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই’। তুমি যেখানে বসতে দেবে, আমিও সেখানেই বসব। ব্যাঙ স্যুপ খেতে ভালোবাসে। তাই সাপকেও খেতে দিল। খাবারের শেষে সাপ ব্যাঙকে বলল, কী হয়েছে বন্ধু আজকাল তুমি আমার সঙ্গে দেখা করছো না কারণ কী? সে বলল, বন্ধু বনের সব পশুপাখি বলে, ‘তোমরা সাপেরা নাকি ব্যাঙেদের (আমাদের) চিরকালের শত্রু! তোমরা নাকি আমাদের খেয়ে জীবন ধারণ করো। এটা কী সত্যি?’ সাপ মিছিমিছি কেঁদে কেঁদে বলল, ‘আমাদের ওপর এত বড় মিথ্যা অপবাদ! ঠিক আছে, তোমারও যদি এমনটা মনে হয়, তাহলে তোমার আর আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভেঙে দাও।’
ব্যাঙ বলল, ‘রাগ করো কেন? আমি তো তাদের কথা কানে তুলিনি। বরং তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছি। সাপ ছলনার হাসি হেসে বলল, বেশ করেছো, এই না হলে আমার বন্ধু। সাপ বলল, ‘বন্ধু প্রায় বিকাল হয়ে এলো আমি এখন যাই।’ তুমিও এক দিন সময় করে আমার বাড়িতে চলে এসো। তুমি না এলে আমি কিন্তু রাগ করব বলে রাখলাম। ব্যাঙ খুশি মনে বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমার বাড়িতে যাব।’
কদিন পর ব্যাঙ, সাপের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। রাস্তায় পদ্মফুলের সঙ্গে দেখা হয়। সে বলল, ‘ব্যাঙ ভায়া এত সাজগোজ করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? সে বলল, ‘নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি সাপের বাড়ি! পদ্মফুলও জঙ্গলের পশুপাখির মতো বলল, ‘সাপ ভালো না খুব দুষ্টু, ওপারের তোমার জাতি ভাইদের এভাবেই ছলনা করে খেয়েছে। দেখো তোমাকেও ওই পাজি সাপটা আজ নইলে কাল খাবেই। তাই বলছি, ব্যাঙ ভায়া সাপের বাড়ির নেমন্তন্ন খেতে যেও না। ব্যাঙ বলল, সাধারণ একটা ফুল হয়ে আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। এই বলেই ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে শুরু করল। ব্যাঙ আর পদ্মফুলের কথা উড়ন্ত এক কাক শুনে জঙ্গলের পশুপাখিদের জানিয়ে এলো।
জঙ্গলের সব পশুপাখি বুঝতে পেরেছে আজ যে সাপের হাতেই ব্যাঙের অঘটন ঘটতে পারে। তাই তারা দেড়ি না করে ব্যাঙের পিছু পিছু যেতে লাগল। ব্যাঙ সাপের বাড়ি গেল। গিয়ে দেখে কী সুন্দর দরজা! সাপের দরজা দেখে ব্যাঙের চোখ কপালে উঠে গেল। তারপর দরজায় কড়া নাড়ালে সাপ দরজা খুলে দেখে তার ব্যাঙ বন্ধু। সে বলল, ‘গরিবের বাড়িতে হাতির পা।’ ব্যাঙ বলল, ‘অমন করে বলো না বন্ধু। সাপ বলল, ‘এখন দাঁড়িয়ে থেকেই কথা বলবা, না ভেতরে আসব।’ ব্যাঙ বলল, অবশ্যই অনুমতি দিলে ভেতরে যেতে পারি। সাপ বলল, আমার বাড়িতে আসতে অনুমতি লাগবে কি? তোমার মানে আমার আর আমার মানে তোমার। আহা! সাপের মিষ্টি কথার ফুলঝুরিতে ব্যাঙ বন্দি হয়ে গেল। ব্যাঙ মনে মনে বলল, সাপ কত ভালো। পশুপাখিসহ পদ্মফুলও সাপের নামে অযথা বদনাম রটাইছে।
সেদিকে সাপ দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। এই সুযোগে সবাই সাপের ঘরে প্রবেশ করল। লুকিয়ে লুকিয়ে সাপের ওপর নজর রাখছিল। সাপ হরেক রকম খাবার ব্যাঙের সামনে এনে দিল। ব্যাঙ এত সুস্বাদু খাবার জীবনে চোখেও দেখেনি। তাই ব্যাঙ সাপের অপেক্ষা না করে খেতে আরম্ভ করল। সাপ ব্যাঙের খাওয়ার ধরন দেখে বলল, খাও বন্ধু খাও! কারণ এটাই তো তোমার জীবনের শেষ খাওয়া। ব্যাঙ বলল, বন্ধু তোমার কথার মানেটা বুঝলাম না। সাপ বলল, বুঝলে না বন্ধু, মানে আবার কবে আসবে এবং এমন খাবার তোমাকে খাওয়াতে পারব কি না এর কি আর কোনো হদিস আছে? সে বলল, ওহ! বুঝেছি তাও ঠিক বলছো।
ব্যাঙ মজার মজার খাবার খেয়ে উঠল। তারপর ব্যাঙ বাড়িতে যাওয়ার কথা যেই না বলল। সাপ বলে উঠল, বন্ধু সবেমাত্র খেয়েছো এখন একটু বিশ্রাম নাও। তারপরও বিকালে তোমাকে আমি দিয়ে আসব। ব্যাঙ, সাপের কথামতো বিশ্রাম করতে গেল। এর কিছুক্ষণ পর সাপ সুযোগ বুঝে ব্যাঙকে মুখে নিয়ে খাওয়ার প্রচেষ্টা করছিল। তখন ব্যাঙ বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার করতে শুরু করল, তখনই জঙ্গলের সব পশুপাখি সাপকে মারতে শুরু করল। একসময় সাপটি মরে গেল। অবশেষে ব্যাঙটি অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল।
ব্যাঙ যাদের এই সাপের জন্য অপমান করেছিল, আজ তারাই জীবন বাঁচাল। ব্যাঙ মাথা নত করে নিজের ভুলের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাইল। সবাই বলল, তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো, তাই আমরা ক্ষমা করে দিলাম। তবে আজ তোমার বোকামির জন্য কী ঘটতে যাচ্ছিল একবার তুমি চিন্তা করছো? সময়মতো কাক যদি আমাদের এসে না বলত, তাহলে আজ একটা অঘটন ঘটে যেত। আমরা তোমার ভালো চাইতাম বলে আগেই তোমাক সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। উল্টো তুমি দুষ্ট সাপটির জন্য আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছো। যাই হোক, কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা মোটেও ঠিক না।
"