মা কাকের আদর
আবদুস সালাম
একটা ভবনের দোতলায় কারিমাদের ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের জানালার পাশে একটা আমগাছ। গাছের কয়েকটা ডাল জানালাঘেঁষে ওপরের দিকে উঠে গিয়েছে। হাত বাড়ালেই গাছের পাতা ছোঁয়া যায়। জানালার পাশে একটা খাট রাখা আছে। খাটে শুয়ে আমগাছটা যেমন দেখা যায়, ঠিক তেমনি বারান্দাতে দাঁড়ালেও গাছটা ভালোভাবে দেখা যায়। কারিমা এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। তাই পড়ালেখার চাপ নেই। খেলাধুলা আর মায়ের সঙ্গে গল্প করেই কারিমার সময়গুলো কাটে। কখনো সে বারান্দায় বসে খেলনাপাতিল নিয়ে খেলা করে। কখনো আবার জানালার শিক ধরে ফ্ল্যাটের নিচে অন্যদের খেলাধুলা দেখে।
আমগাছে বসে থাকা পাখিদের দেখে। পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে। আমগাছে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কাকের। কা কা রবে চারদিকটা মুখরিত থাকে। কারিমার মা রান্নাঘরে রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত। কারিমা খাটে বসে আমগাছের দিকে তাকিয়ে অ.াছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে গাছের ডালে ছোট্ট একটা কাকের ছানা বসে আছে। এমন সময় কোথা থেকে একটা কাক মুখের মধ্যে একটা খাবারের টুকরো নিয়ে উড়ে এসে ছানাটির পাশে এসে বসে। কাকটি মুখে থাকা খাবারটি পা দিয়ে ধরে ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়তে থাকে। তারপর একে একে খাবারের টুকরোগুলো ছানাটির মুখের মধ্যে দিয়ে দেয়। ছানাটি মজা করে তা খেতে থাকে। এক টুকরা খাওয়া শেষ হলে ছানাটি আবার চিঁচিঁ শব্দ করে আর মাঝেমাঝে হাঁ করে আরো কিছু খাওয়ার জন্য। এই দৃশ্য দেখে কারিমা খুব মজা পায়। সে দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলে, ‘মা, মা তাড়াতাড়ি আসো। একটা জিনিস দেখে যাও।’ মা কারিনার পেছনে পেছনে ছুটে যায়। মা দেখে তখনো কাকটি ছানাকে খাওয়াচ্ছে। খাবার টুকরোটি ছোট হয়ে এলে ছানাকে দিয়ে দেয়। ছানাটি খাবার টুকরোটি পা দিয়ে ধরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকে। আর কাকটি চেয়ে চেয়ে দেখে ছানাটি ঠিকমতো খেতে পারছে কি না। খাওয়া শেষ হলে দুজনেই পাশের একটা গাছে উড়ে যায়।
কারিমা মায়ের কাছে জানতে চায়। বড় কাকটি না খেয়ে ছোট কাককে খাবারটি দিল কেন। মা বুঝতে পারে মা পাখির তার ছানাকে খাবার খাওয়ানোর দৃশ্য কারিমা এর আগে কখনো দেখেনি। হাসতে হাসতে মা বলে, ‘বড় কাকটি হলো ছোট কাকটির মা। ছানাটি একা একা খাবার জোগাড় করতে পারে না। তাই মা কাকটি আদর করে তার বাচ্চাকে খাইয়ে দিল।’ মায়ের কথা শুনে একে একে অনেক প্রশ্ন কারিমার মাথায় এসে ভিড় করে। সে মায়ের কাছে জানতে চায় সব পাখি কি ওভাবে বাচ্চাদের খাবার খাইয়ে দেয়? খাবার না দিলে কী হবে? তাহলে কি ওরা মরে যাবে? পাখিরা কীভাবে বুঝতে পারে যে ওদের খিদে পেয়েছে? মা একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে। মা বলেন, ‘একটি মানবশিশু জন্ম নেওয়ার পর তার মা যেমন করে শিশুটিকে লালনপালন করে বড় করে তোলেন, ঠিক তেমনি পশুপাখিরাও তাদের শাবকদের আদর-যত্নে লালপালন করে বড় করে তোলে। বাচ্চাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে। সব মা আদর করে তার বাচ্চাদের খাইয়ে দেয়। শাবকদের নিরাপত্তার জন্য মায়েরা সব সময় সতর্ক থাকে। কেউ যেন তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। পাখির ছানাগুলো যখন উড়তে শেখে, চলাফেলা করতে শেখে, নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করতে পারে, তখন মা-পাখিদের মুক্তি মেলে। আগের মতো তখন আর বাচ্চাদের নিয়ে মা পাখিদের দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কারিমা মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ঝড়-বৃষ্টির সময় কাকছানার ভয় করে না?’ ‘ঝড়-বৃষ্টির সময় মা কাক তার ডানার নিচে বাচ্চাদের আগলে রাখে। মায়ের ডানার নিচে থাকলে ছানাদের আর ভয় করে না।’
কারিমা আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘যখন ডিম ফুটে বাচ্চাগুলো বের হয়, তখন ছানাগুলোকে কেমন দেখায়? মা পাখিরা কীভাবে যতœ করে?’ ‘তুমি কি মা পাখিদের গল্প শুনতে চাও?’ কারিমা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেয়। ‘তাহলে বলছি শোনো। কিছু পাখি আছে জন্মের পর যাদের শরীরে পালক থাকে না। শুধু ছালচামড়া থাকে। চোখে দেখে না। হাঁটতে পারে না। দুর্বল থাকে। এরা হাঁ করতে পারে। মা পাখিরা ঠোঁটের সাহায্যে এদের মুখে খাবার তুলে দেয়। হেরন, বাজপাখি, প্যাঁচা, সামুদ্রিক পাখিই হলো এদের অন্তর্গত। আর কিছু পাখি আছে জন্মের পর, যাদের শরীর পালকে থাকে। এদের চোখ থাকে উজ্জ্বল। মায়ের পিছু পিছু দৌড়াতে পারে। ঠোঁট দিয়ে খাবার খুঁটে খেতে পারে। হাঁস-মুরগি হলো এদের অন্তর্গত। এরা দ্রুত বড় হতে থাকে এবং মা-বাবার কাছ থেকে দ্রুত খাবার জোগাড় করার কৌশল শিখে নেয়।’
পাখপাখালির গল্প শুনে কারিমার শখ হলো সে বাড়িতে হাঁস-মুরগি পুষবে। খাঁচায় পাখি পুষবে। আদর করে ছানাকে খাইয়ে দেবে। কারিমার কথা শুনে মা হাসতে হাসতে বলেন, ‘পাকা ঘরে তো হাঁস-মুরগি পোষা যায় না। তবে তুমি খাঁচায় ময়না, টিয়া অথবা মুনিয়া পাখি পুষতে পারো।’ মায়ের কথা শুনে কারিমা আনন্দে নাচতে থাকে। মা কারিমাকে বলেন, ‘তুমি মা কাকের মতো বাচ্চাকে আদর করতে পারবে তো?’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ পারব। খুব ভালো করে আদর করব।’ মা কারিমাকে আদরে করে কোলে তুলে নেয়। ওর খুশি দেখে মাও খুশি হয়।
"