reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৬ অক্টোবর, ২০২০

নোবেলজয়ী লুইস গ্লুক

অনন্ত উজ্জ্বল

কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এমন একটি নাম ঘোষণায় আসে, যা বিশ্বের সাহিত্যমোদীদের খানিকটা অবাক করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কে পাচ্ছেন ২০২০ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার, এই প্রশ্নে যেসব সাহিত্যিকের নাম বিভিন্নভাবে আলোচনায় এসেছিল অথবা যাদের নামে বাজি ধরা হয়েছিল, তাদের মধ্যে লুইস এলিজাবেথ গ্লুকের নামটি ছিল না। তাহলে বলাই যাই, বাজির দান উল্টে এবার সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন আমেরিকান কবি গ্লুক। এই প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যে নারী নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির ইতিহাসে ১৬তম নারী হিসেবে নাম লেখালেন গ্লুক। ১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত আমেরিকান বিখ্যাত ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের পরে এই প্রথম কোনো আমেরিকান নারী সাহিত্যের আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করল।

মার্কিন সাহিত্যে লুইসের অবদানের বিষয়ে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান আন্ডেরস ওলসন বলেন, ‘গ্লুকের এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তার অসামান্য কাব্যকণ্ঠ ও নিরাভরণ সৌন্দর্যবোধের জন্য, যা এক ব্যক্তিসত্তাকে বহুরূপে সর্বজনীন করে তুলেছে।’ তার লেখায় রয়েছে রসবোধের তীব্র উপস্থিতি আর দৃঢ়তার সঙ্গে সরলতা প্রকাশ। নোবেল কমিটি পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠান থেকে আরো বলেছে, ‘গ্লুকের বেশির ভাগ লেখায় মিথ ও ধ্রুপদি ভাবনার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। এ যাবৎ তার প্রকাশিত সাহিত্যকর্মের প্রধান গুণই হচ্ছে সহজ ও সরলভাবে গভীর কোনো বিষয়কে উপস্থাপন করা। গ্লুকের রচনার অন্যতম বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে শৈশব ও পারিবারিক জীবনযাত্রা, সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের নিবিড় ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সম্পর্কের কথা। আর এভাবেই গ্লুক অন্যদের থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন। গ্লুকের সব সৃষ্টিতেই রয়েছে স্পষ্টবাদিতা। কখনো সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়নি তার কোনো লেখায়।’

এক.

কবি লুইস গ্লুকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ১২টি কবিতার বই। শুধু তা-ই নয়, রয়েছে সাহিত্যের ওপর বেশ কিছু জনপ্রিয় প্রবন্ধ। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফার্স্টবর্ন’। এই বইয়ে তার লেখার ছন্দ, সৌন্দর্য আর সাহিত্যবোধের যে প্রকাশভঙ্গি তিনি উপস্থাপন করেছিলেন, তা প্রশংসিত হয়েছিল সমালোচকদের লেখায়। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে মার্কিন সাহিত্যে নিজের আলাদা পরিচিতি তৈরি করে নেন গ্লুক। তার জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ওয়াইল্ড আইরিস’, ‘অ্যাভার্নো’, ২০১৪ সালে প্রকাশিত তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ফেইথফুল অ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট’ তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিৎজার, ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কটি পুরস্কার রয়েছে নোবেলজয়ী কবি ও প্রাবন্ধিক গ্লুকের ঝুলিতে। ২০১২-এ তার কাব্য সংকলন ‘পোয়েমস ১৯৬২-২০১২’ লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস বুক প্রাইজ জিতে নেয়। এর বাইরে রয়েছে তার কবিতা-সংক্রান্ত প্রবন্ধের বই ‘প্রুফস অ্যান্ড থিয়োরিজ’ ও ‘আমেরিকান অরিজিন্যালিটি’।

গ্লুকের ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ঞযব ঞৎরঁসঢ়য ড়ভ অপযরষষবং গ্র্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট লেখক এবং সমালোচক ওয়েনডি লেজার ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছেনÑ ‘গ্লুকের লেখার ভাষা খুবই সাবলীল, সাধারণভাবে প্রতিদিনের কথা বলার মতো ভাষা। কিন্তু তার কবিতার এই সাবলীল ভাষার গভীর রয়েছে অদৃশ্য এক সুতোর টান! গ্লুকের কবিতায় বেজে উঠে বিচ্ছেদের সুর। সেই সুরের গভীরে কান পাতলে শোনা যায় স্বপ্নভঙ্গে বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়া পাতার শব্দ। তাই তো তিনি লিখতে পারেন ‘আনন্দ শব্দটা ধুলোজমা শব্দের মতো অতীত/অনেক দিন ধরে তাকে খুঁজি/কিন্তু পাই কি?’

কবি যখন পাঠককে এমন একটি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করান, তখন সমালোচকরা তার কবিতা থেকে তুলে আনেন সমাজের-পরিবারের সুখী মেলবন্ধনের পাশাপাশি অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটিকেও। এসবের পাশাপাশি মানবিকতা, নৈতিকতাও উঠে এসেছে তার কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে। বর্তমান সময়ে, প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আগের থেকে অনেক কাছে আসার সুযোগ পেয়েছে। এত কাছাকাছি এসেও মানুষের হৃদয় শুদ্ধতম হৃদয়ে পরিণত হতে পারেনি বরং বিভিন্নভাবে তা কুলষিত হয়েছে। বিশ্বের মানুষ ভালোবাসা ও নৈতিকতার অবক্ষয়ে এখন জর্জরিত। মানবজীবনের এই দিকগুলোকে গ্লুক খুব দক্ষতার সঙ্গে তার কবিতায় তুলে এনেছেন এবং পাঠকের জন্য বোধগম্য একটি রূপে উপস্থাপন করেছেন।

১৯৯২ সালে গ্লুক ঞযব ডরষফ ওৎরং গ্রন্থটির জন্য পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন। ঞযব ডরষফ ওৎরং গ্রন্থটি পাঠ করলে দেখা যায়, এই গ্রন্থটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। এর প্রথম ভাগে রয়েছে কল্পিত একটি বাগান। সেই বাগানের ফুলগুলো কথা বলছে বাগানের মালিক মানে কবির সঙ্গে। দ্বিতীয় ভাগে দেখা যায়, বাগানের মালিক অর্থাৎ কবির নিজস্ব কথোপকথন। আর শেষ মানে তৃতীয় পর্বে রয়েছে ঈশ্বরের বন্দনা। গ্রন্থের তিনটি ভাগ একত্র করলে বোঝা যায়, এই শুধু গল্প নয়, এ যেন একটি পরিপূর্ণ জীবনের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত। যে ভ্রমণের প্রতিটি পথে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। জীবন চলার পথে অনেক সময় সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে, আবার কখনো কোনো একটি প্রশ্নের উত্তর কোনো দিনই মেলে না। অনেক অজানা পথের আবিষ্কার ঘটে, আবার অনেক চেনা পথও অচেনা হয়ে যায়। এ যেন ঘন কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া পথ, যা খুঁজে পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়া এবং খুঁজে পাওয়ার ভেতর দিয়ে নিজের সঙ্গে অন্যের এবং অন্যের সঙ্গে নিজের আত্মিক একটা সংযোগ ঘটে, তারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় গ্রন্থটির পাতায় পাতায়।

২০০১ সালে প্রকাশিত হয় গ্লুকের ঞযব ঝবাবহ অমবং কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থ সম্পন্নভাবে বিভিন্ন সময়ের পৌরাণিক গল্প ও থিমের ওপর ভিত্তি করে লিখেছেন কবি। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোতে কবির নিজস্ব ভাবনা, বিভিন্ন বয়সের স্মৃতি তার সঙ্গে পৌরাণিক গল্প ও মিথের অসাধারণ মিশ্রণ কাব্যমোদীদের কাছে কবিতা পাঠের আনন্দে নতুন স্বাদ যোগ করেছে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ আবৎহড়। কবি গ্লুক এই কাব্যগ্রন্থটি লিখেছেন দেবী পারসোফনির অবয়ব এবং ভাবনাকে ধারণ করে। কাব্যগ্রন্থটির মূল কাহিনিতে বর্ণনা করা হয়েছে মা ও মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক। এই সম্পর্ক সম্পূর্ণই আত্মিক ও ভালোবাসার। মিথের পাখায় ভর করে কবি বর্তমান সময়ের পারসোফনিকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এই খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে কবি পারসোফনিকে নিয়ে তৈরি করেছেন কল্পনার এক ধূম্রজাল। চিত্রকল্প আর মেটাফরের খেলায় মেতেছেন কবি তার নিজস্ব স্টাইলে। কবি এখানে আত্মা এবং শরীরকে বিযুক্ত করে একটি সত্তা আবিষ্কারের চেষ্টায় মত্ত থেকেছেন প্রতি মূহূর্তে।

২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে কবির সবচেয়ে বেশি সমালোচিত এবং বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অ ঠরষষধমব খরভব। এই কাব্যগ্রন্থে কবি মূলত নিজের জীবনের ছবিটাকে বিমূর্তভাবে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। এখানে ভিলেজ বলতে গ্রাম নয়, তিনি একটি সময় এবং সভ্যতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন কীভাবে সেই সভ্যতার ইতি ঘটছে। কীভাবে সেই সময়কে আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

দুই.

ছোটবেলা থেকে পারিবারিক জীবন এবং বাবা-মা আর ভাই-বোনের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক ছিল গ্লুকের। তিনি সেই বিষয়গুলোকে সর্বজনীন করে তুলে এনেছেন তার লেখায়। মিথ ও শাস্ত্রীয় মোটিভ থেকে প্রেরণা নিয়ে বিশ্বজনীন হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা আছে তার প্রতিটি লেখায়। এই প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন ‘আমি যখন ছোট ছিলাম এবং পিতা-মাতার সঙ্গে লং আইল্যান্ডে বাস করতাম, তখন থেকেই কবিতা পড়া এবং লেখার প্রতি আগ্রহী হতে শুরু করি। রাতে ঘুমানোর সময় আমার বাবা গ্রিক পুরাণের বীরদের গল্প শোনাতেন। সেই মিথ আর বীর কাহিনি আমার লেখার মধ্যে অনেকটায় ধরা পড়েছে আমার পরিণত বয়সে।’ এর বাইরে গ্লুকের কবিতায় উঠে এসেছে মানবজীবনের বিভিন্ন সংকট, অভীপ্সা, হৃদয়হীনতা এবং প্রকৃতি। নিঃসঙ্গতা ও বিষণœতা তার কবিতায় বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বলা যায়, নিঃসঙ্গ-বিষণœতাই গ্লুকের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। সমালোচকরা তার কবিতায় খুঁজে পেয়েছেন আত্মজৈবনিকতার সঙ্গে ধ্রুপদী মিথের প্রগাঢ় আন্তঃসম্পর্ক। এটা পরিষ্কার যে, জীবন ও মৃত্যুর শাশ্বত রহস্য আর প্রকৃতির অনিঃশেষ রহস্যময়তাকেই তিনি খুঁজে চলেন তার কাব্যে।

তিন.

গ্লুকের ব্যবসায়ী বাবার লেখক হওয়ার ইচ্ছা ছিল প্রবল কিন্তু ব্যবসা সম্প্রসারণের নানা ব্যস্ততার কারণে মন দিয়ে লিখতে পারেননি কখনো। তার মায়ের মনের মধ্যেও ছিল লেখালেখির সুপ্ত বাসনা। পরিবারে সাহিত্যচর্চার এমন একটি পরিবেশ থাকায় গ্লুক আর তার বোন সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকে। এ বয়সেই তারা ক্লাসনোট লেখার খাতায় গল্প-কবিতা লিখতেন। তারপর সেই লেখার সঙ্গে মিল রেখে ছবি এঁকে দেখাতেন বাবা-মাকে। পরবর্তী সময়ে এসবের কোনো কিছুই কোনো দিন প্রকাশিত হয়নি কোনো মাধ্যমে। এমনকি ষোলো বছর বয়সে গ্লুক তার প্রথম বইয়ের যে ড্রাফ্ট তৈরি করেছিলেন, তাও প্রকাশিত হয়নি।

গ্লুক তার এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের আনন্দমুখর শৈশবে হঠাৎ করেই বিষণœতা নেমে আসে। পরিবারে কলহপূর্ণ এ ঘটনা শুরুই হয়েছিল মূলত তাকে নিয়ে।’ গ্লুক বলেছেন, ‘এ সময় নাট্য অভিনয়ে যুক্ত হওয়া নিয়ে মায়ের সঙ্গে তার সংঘাত চরমে ওঠে। মা-মেয়ের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমঝোতা হতে না হতেই তিনি ক্ষুধামান্দ্য রোগে আক্রান্ত হন। ফলে খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। না খেতে খেতে শরীর দুর্বল হতে থাকে। এ কারণে বেশ কিছুদিন তিনি স্কুলে যেতে পারেননি। এই পরিস্থিতি তার মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি করেছিল। নিয়মিত মনোবিদ্যের চিকিৎসাসহ অন্যান্য চিকিৎসা নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই অসুস্থতার সময়েও চলতে থাকে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন। এর ফলে পরিবারের মধ্যে তিনি একা হতে থাকেন। নিজের একাকিত্বকে অতিক্রম করতে তিনি তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরেন কবিতা। একটু একটু করে সুস্থ হওয়ার সঙ্গে কবিতায় মিশে যান তিনি। কবিতাই হতে থাকে তার আরাধ্য ভালোবাসা, কাক্সিক্ষত গন্তব্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close