reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৮ আগস্ট, ২০২০

মনো অঙ্কের সুখ-অসুখ

সৌর শাইন

ভাই, প্রেসারকুকারটার দাম কত? দোকানদার মজলিস মিয়ার ক্লিন সেভ মুখ অবলোকন করে বলে, স্যার একদাম বলবো না, দরদাম করবেন?

মজলিস মিয়া মাথা তুলে তাকালেন। দেখলেন ছোকরা দোকানদার, তবে কথা বলার স্টাইলে বোঝা যায় কাজে যথেষ্ট ঝুনা।

মজলিস মিয়া বলেন, কোনটা ভালো হবে একদাম না দরদাম?

কোনটা ভালো হইবো হেইডা আপনেরে বাছাইকরণ লাগবো। দরদামে কথাকাটাকাটি করতে হইবো, একদামে নো কথা নো সেকেন্ড দাম, যা বলমু তাই দিয়া নিতে হইবো।

মজলিস মিয়া এবার বলেন, তোমার জন্যি কোনটা ভালো হইবো?

দোকানদার বলে, একদাম দরদাম যেকোনো একটার মইধ্যে আপনে কিনলেই আমার ভালো হইবো।

এবার মজলিস মিয়া একগাল হেসে বলেন, ঠিক আছে বেটা, একদামে মালখানা খরিদ করমু।

ছয় হাজার পাঁচশ, একদাম। ভালো কুকার মেইড ইন জাপান। চায়না ইন্ডিয়ান দুই নাম্বার মাল আমরা রাখি না। ওইসব মাল এক মাস ইউজ করার পরই নষ্ট অইয়া যাইবো গা। আর এইডা জীবন পার হইয়া যাইবো তাও চলতে থাকবো।

ছোকরা দোকানির কথায় মজলিস মিয়া মুগ্ধ হয়ে তেরোখানা পাঁচশ টাকার নোট দোকানদারের হাতে দিয়ে প্রেসারকুকারের প্যাকেট ও ক্যাশ মেমোটা পকেটে পুরে দোকান থেকে বের হলেন।

বাসস্ট্যান্ডমুখী হাঁটতে হাঁটতে মজলিস মিয়া ভাবছেনÑ বাসায় গিয়ে স্ত্রীকে কীভাবে সারপ্রাইজটা দেবেন। বলবেন কী, বউ তোমার দীর্ঘদিনের ঘ্যান ঘ্যান গানের অবসান হলো আজ। নাহ্, কথাটার মধ্যে তাচ্ছিল্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এভাবে বলা যাবে না।

কী বলা যায়? শোনো, শাকিলা বিবি, দেখো তোমার স্বপ্নের কুকারটা আজ কিনেই ফেললাম। এত দিন তো কম কথা শোনাওনি, ওসব ভুলে গিয়েও কুকারটা কিনে আনলাম। না, এই কথাটাও বলা যাবে না, শেষ অংশ শুনে খেপে গিয়ে প্রেসারকুকারটাই ছুড়ে মারতে পারে। কথাটা জাস্ট এভাবে বলতে হবে, দেখো তো, কুকারটা তোমার পছন্দ হলো কি না?

আচ্ছা, যদি পছন্দ না হয়, পাল্টে আনতে বলে তখন তো আরেক ঝামেলা। কথাটা বলতে হবে এভাবে, অফিস থেকে ফেরার পথে ভাবলাম কুকারটা কিনে ফেলি, যেই ভাবা সেই কাজ, ব্যস কিনেই ফেললাম। কথাটা এভাবে প্রকাশ করলে ব্যক্তিত্ব মাধুর্য টিকে থাকে।

মজলিস মিয়া গাড়ির সিটে বসার পর, একজন জিজ্ঞেস করল, ভাই কুকারটা কত হলো?

মজলিস মিয়া হাসিমুখে বলল, সাড়ে ছয় হাজার টাকা, অরিজিনাল জাপানি প্রডাক্ট।

দেখা যাবে?

কেন নয়, শিওর, প্যাকেট খুলে দেখুন না।

লোকটা প্রেসারকুকারটা উল্টে-পাল্টে দেখে বললেন, ভালো দরে কিনেছেন ভাই, গত সপ্তাহে সেইম কুকার আমি আট হাজার টাকায় কিনেছি, খুব ঠকেছি।

কথাটা শুনে মজলিস মিয়া আনন্দ আকাশ ভেঙে নামলো। এক টাকা আর দুটাকা না, দেড় হাজার টাকার তফাত, এত দারুণ জিতে যাওয়া।

মজলিস মিয়া বাসায় ফিরে সোজা গোসলে গেলেন, মনস্থির করা কথা বলে প্রেসার কুকারটা স্ত্রীর হাতে তোলে দেওয়া হলো না। মজলিস মিয়া উলঙ্গ হয়ে নেচে গেয়ে গোসল করলেন। আনন্দের হাতিয়ার বেঁচে যাওয়া দেড় হাজার টাকা। এই দেড় হাজার টাকা কীভাবে খরচ করবেন, সে চিন্তায় বিভোর মজলিস মিয়া।

প্রেসারকুকার পেয়ে শাকিলা বিবি ভীষণ খুশি। সে খুশির ঝাপ্টা লেগেছে গোটা সংসারে। মজলিস মিয়া স্ত্রীর সুন্দর আচরণে শতাব্দীর সেরা সুখী মানুষ ভাবতে লাগলেন নিজেকে। বিকালে জম্পেশ একটা ঘুম দিলেন। ঘুমের ভেতরেও আনন্দময় স্বপ্নের দেখা। উদ্বৃত্ত দেড় হাজার টাকা খরচের জন্য একটা মোক্ষম ক্ষেত্র তিনি অনুসন্ধান করে চলেছেন।

ছুটির দিনে একটা ট্যুর হলে কেমন হয়? খুব বেশি দূরে নয়। রিকশায় চড়ে ভার্সিটি ও মেডিকেল এরিয়া, শহীদ মিনার-দোয়েল চত্বরসহ। বাইরে একটু খানাপিনা হলেও তো খারাপ হয় না। নীরব রেস্টুরেন্টের ব্রিফ সিজলিং খুব পছন্দ করে শাকিলা, শেষ কবে ওখানে যাওয়া হয়েছিল মনেই পড়ে না। পুঁজিবাদের পাপে অভাব-অনটনে ভালোবাসাটুকুও পালিয়েছে, মেজাজ হয়েছে খিটখিটে বিদঘুটে। বছরব্যাপী সংসারে কথাকাটাকাটি-ঝগড়াঝাটি করেই ক্লান্ত থাকে শরীর ও মন। উদ্বৃত্ত দেড় হাজার টাকায় একটা সারপ্রাইজ হয়ে গেলে তো ভালোই হয়। তো যাওয়া যাক রেস্টুরেন্টে, একটু হাসি আনন্দ ও সেলফিতে কাটুক কিছুটা সময়।

সন্ধ্যার আগে ঘুম ভাঙার পর স্বপ্নটার জন্য খুব মায়া হতে থাকে মজলিস মিয়ার। টুক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, স্বপ্নটা এখনই সত্যি করা চাই। এক মুহূর্ত দেরি নয়।

মজলিস মিয়া স্ত্রীকে তাড়া দেন, রেডি হতে। শাকিলা বিবি চিরচেনা কৃপণ দরিদ্র স্বামীর আচরণে আসমান থেকে পড়েন আবার মনের ভেতর আনন্দও জাগে। পুরো সন্ধ্যা রিকশায় ঘুরে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে রাত ৯টায় উনারা বাসায় ফেরেন।

মজলিস মিয়া ফ্রেশ হয়ে জামা পাল্টে সোফায় বসার পরপর কলিংবেল বাজল। দরোজা খুলতেই দেখলেন, পাশের বাসার জাহেদা বেগম।

বহু দিন ধরে আপনাদের বাসায় আড্ডা দেওয়া হয় না, তাই আজ চলেই এলাম।

মজলিস মিয়া হেসে বললেন, কোনো অসুবিধে নেই ভাবি, ভেতরে আসুন না।

হঠাৎ অতিথি আগমনে আপ্যায়নস্বরূপ শাকিলা বিবি এক কাপ চা-বিস্কুটের আয়োজন করলেন। কথায় কথায় অনেক কথার স্রোত বয়ে গেল। সদ্য কেনা প্রেসারকুকারের প্রসঙ্গও এলো, দাম শুনতেই জাহেদা বেগম মাথায় হাত দিলেন। বললেন, সর্বনাশ করেছেন মজলিস ভাই, হুবহু একই রকম প্রেসারকুকার আমি সাড়ে তিন হাজার টাকায় কিনেছি। দাঁড়ান এনে দেখাচ্ছি।

কথাটা বলেই জাহেদা হন হন করে বেরিয়ে গেলেন ও নিজের প্রেসারকুকারটা হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। উল্টে-পাল্টে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেনÑ প্রেসারকুকার দুটোতে তফাত নেই।

মজলিস মিয়া চুপসে গেলেন। তার ভেতর তরতর তরুলতার মতো জেগে ওঠা লাভ্যানন্দ মুহূর্তে মাটি হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close