reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২১ আগস্ট, ২০২০

পার্লামেন্ট স্কয়ার : ওয়েস্ট মিনিস্টার এবে

হাফিজ উদ্দীন আহমদ

সাড়ে ১০টার দিকে বের হলাম সবাই। আমি, প্রেটি ও নাহিদ। আজ বৃষ্টি নেই, শীতও নেই খুব একটা। তবু ওভারকোট নিলাম। বিলাতের আবহাওয়াকে বিশ্বাস করা যায় না। হেঁটে ওয়েস্টহাম গেলাম, সেখান থেকে ডিস্ট্রিক্ট ট্রেনে চড়ে সটান ওয়েস্ট মিনিস্টার আন্ডারগ্রাউন্ড। বিরাট স্টেশন এটি। সার্কল, ডিস্ট্রিক্ট ও জুবিলি লাইনের গাড়ি এ স্টেশন ছুঁঁয়ে যায়। কোথায় যেতে কোন ট্রেন ধরতে হবে এবং কোনদিক দিয়ে স্টেশন থেকে বের হলে কোন রাস্তায় গিয়ে পড়ব, সব বড় করে নির্দেশ দেওয়া। দীর্ঘ এস্কেলেটরে চেপে ভূতল থেকে বাইরে আসতে থাকলাম। এত দ্রুত গতিতে সিঁড়িগুলো ভাঁজ হচ্ছে ও খুলছে যে, পড়ে যাওয়ার ভয়। দেখি লেখা পাশে : প্লিজ কিপ টু দ্য রাইট অ্যান্ড হোল্ড দ্য হ্যান্ডেল। ট্রেনে দেখেছি ডিজিটাল স্ক্রিনে স্টেশনের নাম, পরবর্তী স্টেশনের নাম ও শেষ গন্তব্য জানিয়ে দেওয়া হয় প্রতি স্টেশনে, সেই সঙ্গে মাইক্রোফোনে ঘোষিত হতে থাকে : প্লিজ মাইন্ড দ্য গ্যাপ বিটুইন ট্রেন অ্যান্ড প্ল্যাটফরম। অসচেতন থাকলে যেকোনো সময় এই ফাঁকে পা পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রথমেই পার্লামেন্ট স্কয়ারে চলে এলাম। এটা ওয়েস্ট মিনিস্টার শহরে। চারদিক খোলামেলা গাছপালাযুক্ত সবুজ চত্বর। জানলাম ভ্রমণকারী আর রাজনৈতিক সমাবেশকারীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু জায়গাটা। একটু পরপরই নামকরা লোকদের ভাস্কর্য। প্রথমে চোখে পড়ল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মহানায়ক স্যার উইনস্টন চার্চিল ব্রোঞ্জের মূর্তি হয়ে অনড় হয়ে আছেন। রয়েছে বিলাতের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ, আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখদের ভাস্কর্য। এলাকাটিকে ঘিরে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা : হাউস অব পার্লামেন্ট,

সুপ্রিম কোর্ট, ওয়েস্ট মিনিস্টার এবে। হেঁটে হেঁটে ওয়েস্ট মিনিস্টার এবের সামনে এলাম। আসলে এটা একটা গির্জা। বাইরে ফুটপাতঘেঁষে বিরাট বিলবোর্ড। তাতে বড় করে লেখা : ওয়েলকাম টু ওয়েস্ট মিনিস্টার এবে। বিলবোর্ডের নিচের অংশে অনেক সচিত্র প্রতিবেদন। ৯৬০ সালে বেনেডিক্টিন সন্ন্যাসীরা এই এবে বা মঠ স্থাপন করেন। হাজার বছর ধরে এখানে রাজা-রানিদের রাজ্য অভিষেক অনুষ্ঠান হয়। রানি ভিক্টরিয়া, এলিজাবেথ ১, এলিজাবেথ ২Ñ সবার মাথায় এ স্থানেই মুকুট পরানো হয়েছে। রাজা-রানিদের বিয়েও হয় এখানে। আবার এলিজাবেথ ১, হেনরী ৩, এডওয়ার্ড ১, ৩, স্কটিশ রানি মেরি ১৭ জন রাজা-রানির মূর্তিসহ কারুকার্যম-িত সমাধিও রয়েছে। চার্লস ডারউইন, আইজাক নিউটনের মতো ব্যক্তিরা অনন্ত শয়নে শায়িত এবেতে। পোয়েট্স কর্নারে সমাহিত বা স্মরণীয় করে রাখা আছে সব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : লর্ড বায়রন, জর্জ ইলিয়ট, চার্লস ডিকেন্স প্রমুখ। তবে শেকসপিয়ার এখানে সমাহিত কি নাÑ এ নিয়ে দ্বিমত আছে। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধানরাও এখানে এসে মিলিত হন। অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ হলরুম ভেতরে। ডায়মন্ড জুবিলি গ্যালারি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ভেতরে প্রার্থনা করতে গেলে বা গির্জার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কোনো পয়সা লাগে না, অন্যথায় টিকিট কেটে ঢুকে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা যায়। এ তথ্য আগে জানা ছিল না। ভেতরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম। অগত্যা সে ইচ্ছা বাদ দিয়ে বাইরে থেকেই ওয়েস্ট মিনিস্টার এবের ছবি তুলেই ক্ষান্ত হলাম।

কাছেই পার্লামেন্ট, মাঝখানে বিরাট রাস্তা। সড়কের রেলিংয়ের গায়ে ফলক লেখা : পার্লামেন্ট স্কয়ার, এস ডব্লিউ-১, সিটি অব ওয়েস্ট মিনিস্টার। ধীরে ধীরে হেঁটে রাস্তা অতিক্রম করলাম। প্রেটি ছোট শিশুর মতো আমার হাত ধরে তা পার করল। সামনেই বিশাল রাজকীয় ভবন। পার্লামেন্ট হাউস। এর অপর নাম ওয়েস্ট মিনিস্টার প্যালেস। ঘিয়া রঙের এ বহুতল অট্টালিকা টেমস নদীর বামতীরে। প্রাচীরে লেখা : হাউস অব পার্লামেন্ট। ট্রেসপাসার্স উইল বি প্রসেকিউটেড। ভেতরে ঢোকা গেল না। গেট বন্ধ। শুধু অধিবেশন চলাকালে পার্লামেন্টে প্রবেশ করা যায়। আর হাউসেস অব পার্লামেন্টে ঢুকতে টিকিট কাটতে হয়। অগত্যা বাইরের চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্যালেসের বাইরে হাউস অব লর্ডসের প্রবেশপথে দর্শনীয় ব্রঞ্জের ভাস্কর্য। ঘোড়ার পিঠে তলোয়ার উঁচিয়ে আছে শিরস্ত্রাণধারী এক ব্যক্তি। জানলাম ইনি বারো শতকের ইংরেজ রাজা রিচার্ড ১, যাকে সবাই রিচার্ড দ্য লায়ন হার্ট বলে জানে। ১১৮৯-১১৯৯ সালে তিনি শাসন করেছেন। ইতালির ব্যারোন কার্লো এই ভাস্কর্য নির্মাতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির বোমায় সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তবে তা মেরামত করে নেওয়া হয়েছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ এলিজাবেথ টাওয়ার। তার মাথায় শোভা পাচ্ছে লন্ডনের প্রখ্যাত পেটা ঘড়ি বিগ বেন। এই দেশবাসীর গর্ব এটা। ঘড়িটার বৈশিষ্ট্য হলো চারদিকেই এর ডায়াল। ডায়ালের ব্যাসার্ধ ২৩ ফুট। মাটি থেকে ৩১৫ ফুট উঁচুতে। ৩১ মে, ১৮৫৯ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত সময় দেওয়া আর সবচেয়ে জোরে ঘণ্টা বাজানো এ ঘড়িটি স্থাপিত হয়েছিল। পাঁচটি ঘণ্টা আছে এ যন্ত্রে, ওজন ১৩.৭ টন। অগাস্টাস পুগিন বিগবেনের নির্মাতা। মাটি থেকে এত উঁচুতে যে, নিচ থেকে তার আকারের বিশালত্ব ঠিক বোঝা যায় না।

চত্বর ছেড়ে আবার সামনের ফুটপাতে চলে এলাম আমরা। চওড়া রাস্তায় কর্তব্যরত মাথায় নীল হ্যাট আর হলুদ জ্যাকেট পরিহিত লন্ডনের কয়েকজন স্মার্ট পুলিশ কর্মী। জ্যাকেটের পেছনে বড় বড় করে লেখা : মেট্রোপলিটান পুলিশ। আমাদের কাছাকাছিতেই দুজন। প্রেটি জিজ্ঞাসা করল : আব্বু, পুলিশের সাথে ছবি তুলবা? ভাবলাম আইডিয়াটা খারাপ না। আমরা কাছে গিয়ে অফিসারটিকে অভিবাদন জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম : ক্যান উই টেক এ ফটোগ্রাফ উইথ ইউ? তিনি সানন্দে রাজি হলেন। তবে আমাদের ফুটপাতে থাকতে বলে তিনি ফুটপাতের কিনারে রাস্তায় আমাদের কাছঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমি তার বিচক্ষণতা দেখে অবাক হলাম। আমরা ফুটপাতে আর তিনি রাস্তায় থেকে ছবি তোলার পোজ দিলেন। কোনো আইন ভঙ্গ হলো না। ধন্যবাদ দেওয়ার পর নাম জিজ্ঞাসা করলেন। পরিচয় দিলাম। জানালাম আমি ডাক্তার, বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছি।

: বাহ। বাংলাদেশি শেফরা খুব ভালো। আমি তাদের রান্না খুব পছন্দ করি।

: খুব ভালো লাগছে শুনে।

: কদিন থাকবেন?

: এক মাস।

: এবার আবহাওয়া খুব ভালো। আপনার ভ্রমণ সুন্দর হোক।

হাত মিলিয়ে বিদায় নেওয়ার আগে তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। উইলিয়াম বা এ জাতীয় কিছু বললেন, এখন আর তা মনে নেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close