reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২১ আগস্ট, ২০২০

বাস্তবতার অমর শিল্পী মুর্তজা বশীর

মৃধা আলাউদ্দিন

দেশের আধুনিক চারুকলা শিল্পীদের অন্যতম মুর্তজা বশীর। যার শিল্পী জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দÑ তিনি বাবা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাবার একটি স্কেচ করেছিলেন। আগেও করেছিলেন। কিন্তু দূর থেকে, বাবা যেন বুঝতে না পারেন। সেবারই প্রথম বাবাকে মডেল করে সামনে বসিয়ে রেখে গভীরভাবে দেখে দেখে এঁকেছিলেন ছবি।

মুর্তজা বশীরের জন্ম বগুড়ায়, ১৭ আগস্ট ১৯৩২। মৃত্যু ঢাকায় ফার্মগেটের পাশে তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে, ১৫ আগস্ট ২০২০। মুর্তজা বশীর ছিলেন চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট এবং ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তিনি ১৯৪৯ সালে বগুড়া করনেশন ইনস্টিটিউট থেকে মেট্রিক পাস করেন। ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। ১৯৪৮-এ ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে, তিনি বগুড়া শহরে আন্দোলনের জন্য বেশ কয়েকটি মিছিল এবং মিটিং আয়োজনে কাজ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানবিরোধী কার্টুন আঁকার কারণে পাঁচ মাস কারাভোগ করেন এবং পরিশেষে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসেন। ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলার মিটিংয়ে যোগ দিয়েছিলেন। সেই দিনের পরবর্তীকালে, ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে ঢাকা জাদুঘরে প্রদর্শনী মুলতবি রাখতে অন্যদের সঙ্গে তিনি ঢাকা জাদুঘরে যান। ভাষাসৈনিকদের জন্য ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখের গায়েবানা জানাজাতেও যোগ দেন মুর্তজা বশীর এবং পুলিশ আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করলে তারা পালিয়ে যান। তিনি আন্দোলনের জন্য অনেক এবং কার্টুন-ফেস্টুন এঁকেছেন। তার কার্টুন দেশ ও ভাষার জন্য লড়াই এবং ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমনÑ ৫২ ও ৭১ স্মরণ করা হয় কবি নজরুলের গান-কবিতা।

২.

মুর্তজা বশীর ছোটবেলা থেকে আর্টিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। ছবি আঁকা তার কল্পনায়ও ছিল না। এটা ঘটনাচক্রে ঘটে গেছে। তবে আঁকা ছবি দেখতে তার খুব ভালো লাগত। বাবার লাইব্রেরিতে প্রচুর পত্রিকা আসত। কলকাতা থেকে। দিল্লি থেকে। পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে তাদের বাসায় বইপত্র, ম্যাগাজিন আসত। সেসব বইপত্র ও পত্রিকায় আঁকা ছবি ছাপা হতো। বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি ছাপা হতো। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় ইউরোপের শিল্পীদের ছবি ছিল। ওগুলো দেখতে মুর্তজা বশীরের খুব ভালো লাগত। ১২ বছর বয়সে স্কুলের বইয়ে আঁকা রেখাচিত্রে বাবার খাতা দেখার লাল-নীল কলম দিয়ে তিনি আঁকা শুরু করেন। আসেন ছবির জগতে। মুর্তজা বশীর ছোটবেলা থেকেই ভাবতেন বিদেশি মেম বিয়ে করবেন। শ্যামলা মেয়েরা রাগ করতে পারে, কিন্তু শ্যামলা রং তার পছন্দ নয়। হয় খুব সাদা, না হয় খুব কালো মেয়েদের তার পছন্দ। কালো মেয়েদের বলতেন মেঘের মতো গায়ের রং। অবশেষে আমরা দেখেছি, তার স্ত্রীর গায়ের রং খুব ফর্সা ছিল। সবুজ ছিল চোখ। মুর্তজা বশীর ষাটের দশকে যখন তার হবু স্ত্রীকে দেখেন, তখন তিনি ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন। দেখেই মনে হয়েছিল, তিনি তাকেই বিয়ে করবেন এবং ১৯৬২ সালে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর শিল্পী মুর্তজার আঁকায় নতুন রং যোগ হয়Ñ সোনালি-রুপালি। মুর্তজা বশীরের আঁকায় জ্যামিতিক ধরন আসে তখন থেকে। মুর্তজা বশীর বাংলাদশেরে প্রথম প্রজন্মের এক আধুনিক শিল্পী। মর্ডানস্টিদের পথিকৃৎ। নানামুখি সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন থেকেছেন সারা জীবন। চিত্রকলায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, ক্যানভাসে কখনো দেয়ালের ধুসরতা খুঁজেছেনে, তুলির আঁকিবুকিতে গড়ে তুলেছেন এপিটাফ।

শিল্পীর চোখমাত্রই সৌন্দর্য সন্ধানী ও সৌন্দর্য নির্মাতা, ফলে তুলির আঁচড়ে মুর্তজা বশীর দর্শককে নিয়ে যান এক ভিন্ন মায়াবি জগতে। শিল্পী মুর্তজা তার আশপাশকে সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলতে চান, কামনা করেন রংভর্তি মায়াবি জগৎ; তাই-ই যেন ফুটিয়ে তুলেছেন তার ‘দ্য উইংস’ সিরিজে। তিনি ১৯৯৮ সালে প্রথম আঁকতে শুরু করেন ‘উইংস’ সিরিজের ছবিগুলো। ছবির জগতে মুর্তজা বশীর ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ নামে যে নিজস্ব ধারার সৃষ্টি করেছিলেন, ‘দ্য উইংস’ সিরিজটি সেই ধারারই ছবি। এ সিরিজে ছবির বিষয় হিসেবে মুর্তজা বশীর বেছে নিয়েছেন প্রজাপতির ডানার রূপকে, কেননা প্রজাপতির ডানার মধ্যে রয়েছে বিচিত্র মায়াময় রং ও রেখা। ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে শিল্পী ম্যাগনেফাইং গ্লাস দিয়ে দেখেছেন বিভিন্ন প্রজাপতির ডানার সূক্ষ্ম কারুকাজ, তারপর ওই সূক্ষ্মতাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তুলির আঁচড়ে। নিজস্বতায়। আপন আয়নায়।

৩.

মুর্তজা বশীর আর্ট স্কুল থেকে পাস করার পর ১৯৫৫ সালে বছরখানেক নবাবপুর সরকারি স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাবার অর্থে ইতালির ফ্লোরেন্সে যান। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। এ সময় অধ্যাপক কাপুকিনি ছিলেন তার শিক্ষক। তার কাজে ফিগারের সরলীকরণ ও ন্যূনতম রং ব্যবহারের শৈলী তাকে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্লোরেন্সে তিনি পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। অ্যাকর্ডিয়ান বাদক, জিপসির খেলা দেখানো, মা ও মেয়ের বাজার করে ফেরার দৃশ্য এঁকেছেন তিনি। ইতালিতে দুবছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ফ্লোরেন্স ছেড়ে আসার আগে শিল্পী মুর্তজার প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল ‘লা পার্মানেন্ট’ গ্যালারিতে। এতে ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালীন আঁকা তার ১৪টি তৈলচিত্র ছিল। ১৯৫৮ সালে বশীর ইতালীয় চিত্রকর রাপিসার্দি ও ভাস্কর ম্যাডোনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে ‘মুভিমেন্টো প্রিমোরডিও’ (আদিমতার আন্দোলন) নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং ফ্লোরেন্সের অদূরে অ্যাম্পোলি শহরে গ্রুপ প্রদর্শনী করেন ১৯৫৮ সালের ১৩ থেকে ২৫ এপ্রিল।

দেশে ফিরে ১৯৭৩ সালের আগস্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর ১২ বছর আঁকেন শতাধিক ছবির একটি সিরিজ। যার নাম ‘বশীর দি উইংস’। ভাষা সংগ্রামী মুর্তজা বশীর ছিলেন একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক। এমনকি চলচ্চিত্র অঙ্গনেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একসময় শিল্পনির্দেশনা দিয়েছেন উর্দু ও বাংলা চলচ্চিত্রে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘নদী ও নারী’র চিত্রনাট্য মুর্তজা বশীরের করা।

৪.

মুর্তজা বশীর নিজেকে একজন সানডে পেইন্টার মনে করতেন। মনে করতেন শৌখিন চিত্রকর। তিনি সারা বছর আঁকতেন না। না আঁকলেও, ভাবতেন সর্বক্ষণ। কী আঁকবেন, কোথায়, কখন কী রং ব্যবহার করবেন। এসব ভেবে ভেবে ঠিক করে তারপর আঁকতে শুরু করতেন। মুর্তজা বশীর বলেন, ছবি আঁকা অনেকটা সন্তান প্রসবের মতো। পূর্ণ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য নয় মাস দশ দিন ধরে তাকে বহন করতে হয়। তার আগে হলে অসম্পূর্ণ হয়। ছবি আঁকা নিয়ে মুর্তজা বশীর আরো বলেন, ধরো আমি কিছু রং ঠিক করেছি কোন কোন রং দিয়ে কী কী ছবি আঁকব। লাল নীল কমলা। কিন্তু আঁকতে গিয়ে দেখলাম প্লেটে আছে অন্য রং। লাল-সবুজ। তখন আমি ওই রং ফেলে দিই না। ওই রং দিয়েই ছবি আঁকি। রং ফেলে দিতে আমার মায়া লাগে। যে রং দিয়ে যেভাবে আঁকব ভেবেছিলাম। আঁকতে গিয়ে সেটা বদলে ফেলতে হয়। হয়তো ভেবে রাখা ছবিটিই আঁকছি, তবে ভেবে রাখা রঙে নয়। এর কারণ হলো, আমাদের দেশে রং পাওয়া যায় না। আরেকটা ব্যাপারও আছে। কোনো ধরাবাধা রঙে আঁকতে থাকতে চাই না। আর্টিস্টের যদি কোনো রঙের প্রতি দুর্বলতা থাকে, তাহলে শিল্প সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তখন আর ছবি আঁকা যায় না। ভালো হয় না শিল্প।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close