বীরেন মুখার্জী

  ১৪ আগস্ট, ২০২০

গীতিকবিতার শামসুর রাহমান

বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে কাব্যচর্চা শুরু করেন। তিরিশের কবি জীবনানন্দের নিজস্ব দর্শনজাত কবিতা তার কাব্যের প্রথম মৌলিক প্রেরণা হিসেবে শনাক্ত করা যায়। তবে অচিরেই তিনি এ প্রভাব কাটিয়ে সমহিমায় আবির্ভূত হন। সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধÑ বাঙালির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য পরিম-লে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কবিতায় এর প্রভাব ও বিপুল প্রসার ঘটে। পরিবর্তনের এই ধারায় শামসুর রাহমানের রচনাসম্ভারেও পরিবর্তন আসে। তবে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার শুদ্ধতম পরম্পরা ধারণ করেই কবিতাকে এগিয়ে নেন।

বাংলা ভাষার অগ্রসর এই কবি কবিতার পাশাপাশি ‘গীতিকবিতা’ রচনার ক্ষেত্রেও অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী রুনা লায়লার কণ্ঠে যখনÑ ‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে/পানি টলটল মেঘনা নদীর কাছে/আমার অনেক ঋণ আছে।/বকের ডানায় ছাওয়া চরের কাছে/চাঁদ জাগা বাঁশ বাগানের কাছে/আমার অনেক ঋণ আছে।’ গানটি শ্রবণ করি, তখন অজান্তেই নিজ নিজ আত্মানুসন্ধানে ডুবে যাই। শামসুর রাহমান প্রবল দেশপ্রেম ঢেলে গানটির বাণী রচনা করেছেন, যে কারণে বাঙালি শ্রোতা এই গানে সম্মোহিত না হয়ে পারে না। গীতিকবিতাটিতে সুরারোপ করেছিলেন সুরকার খোন্দকার নুরুল আলম। শামসুর রহমান মূলত গান রচনায় উৎসাহিত হন এই সুরকারের অনুপ্রেরণায়। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সুরকার খোন্দকার নুরুল আলমকে খুব পছন্দ করতেন। জানা যায়, কাব্যসুষমাম-িত এই গানটি ১৯৭৮ সালের দিকে তিনি নুরুল আলমকে দেন। গানের কথা, সুর এবং গায়কিÑ সবকিছু মিলিয়ে গানটি শোনা মাত্রই বাঙালি হৃদয় গানটির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলা ভাষায় এ যাবৎ যত দেশপ্রেমমূলক গান রচিত হয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম সেরা।

কবি শামসুর রাহমান ষাট ও সত্তর দশকে রেডিও-টেলিভিশনের জন্য গীতিকবিতা রচনা করেন। কয়েকটি চলচ্চিত্রের জন্যও গীতিকবিতা রচনা করেন তিনি, যার বেশির ভাগই যৌবনে রচিত। স্বাধীনতার পর দেশাত্ববোধক গীতিকবিতা লিখে বাংলা গানের ভা-ার সমৃদ্ধ করেছেন। দেশের প্রথিতযশা সুরকাররা কবির গানের বাণীতে সুরারোপ করেছেন, আবার গেয়েছেনও দেশের খ্যাতনামা শিল্পীরা। সুরকারদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল আহাদ, সত্য সাহা, খোন্দকার নুরুল আলম, সমর দাস প্রমুখ। তবে শামসুর রাহমানের বেশির ভাগ গীতিকবিতায় সুর সংযোজন করেছেন খোন্দকার নুরুল আলম। দেশপ্রেমমূলক গীতিকবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি আধুনিক গীতিকবিতাও রচনা করেছেন। তার লেখা গীতিকবিতাÑ ‘জননী আমাকে দিয়েছ অন্ন জল, ‘শ্যামল কোমল শান্ত ছায়ায়’, ‘আমার সবাই একাত্তরের শহীদের সন্তান’, ‘অঙ্গে আমার কী মধুর বাজে অনাদিকালের হাসি’, ‘তোমরা ঘুমাও আমি জেগে থাকব’, ‘এ দেশ আমার চোখের আলোয়’, ‘আগুনের অক্ষরে লেখা নাম নজরুল’, ‘আলো ছড়াও ভালোবেসে, যখন আকাশে পায়রা উড়ে’, ‘এ স্মৃতিসৌধে শিশির ঝরে’, ‘নদীটির কাছে নদী এসে বলে গল্প শোনায় বলো’, ‘কৃষ্ণচূড়ার হাসি আমার প্রিয়’, ‘ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে’, ‘এই মাটির কণা’, ‘স্বাধীনতা তুমি আছ বলে গোলাপ চামেলী ফোটে’, ‘এ দেশ আমার’, ‘নীল দিগন্তে সোনালী স্বপন’, ‘কালের তিমিরে এসেছে আলোর পায়রা’, ‘এই দিন চিরদিন’ ইত্যাদি। যেসব চলচ্চিত্রের জন্য তিনি গীতিকবিতা লিখেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ‘মাটির পাহাড়’। মহিউদ্দিন পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। পরে তিনি ‘এইতো জীবন’, ‘বাঁধন হারা’, ‘রাজবাড়ি’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রের জন্য গীতিকবিতা রচনা করেন।

শিল্পীদের মধ্যে রুনা লায়লার কণ্ঠে কবির ‘স্মৃতি ঝলমল সবুজ মাঠের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে’ গানটির পাশাপাশি ‘ফসলের মাঠে মেঘনার তীরে, ধূ ধূ বালুচরে তুমি-আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা’ গানটিও জনপ্রিয়তা পায়। ফেরদৌসি রহমানের কণ্ঠে শামসুর রাহমানের ‘মধুময় পৃথিবীকে নীল আকাশ ডাকবেই’ এবং ‘তুমি কে এমন বুঝিনাতো’ গান দুটি প্রশংসিত হয়। শিল্পী-লেখক বাবু রহমান তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, ‘শ্রোতা হৃদয়ে প্রবলভাবে দোলা দেওয়া ‘কখনও আমার মাকে গাইতে শুনিনি কোনো গান’Ñ এটির গীতিকার শামসুর রাহমান। কণ্ঠ দিয়েছেন রফিকুন নবী।’ এ ছাড়া নাহিদ নিয়াজীর কণ্ঠে ‘বাতাসেরে বলি বল কে গো আমি’ এবং সৈয়দ আবদুল হাদীর কণ্ঠে ‘কতদূর নিয়ে যাবে’ গান দুটির রচয়িতাও কবি। কবির কয়েকটি গীতিকবিতা ব্যান্ডসংগীতের দলেও গীত হয়েছে।

শামসুর রাহমান আপদমস্তক একজন আধুনিক কবি। তাকে নাগরিক কবি অ্যাখ্যা দেওয়া হলেও তার রচিত গীতিকবিতার মধ্যে কবির প্রকৃতি-ভাবনা এবং দেশপ্রেমের স্বচ্ছতা স্পষ্ট। ১৯৭১ সালে রচিত ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার চিন্তাভাষ্যে তিনি যেমন ভাষার স্বাধীনতা আর কবিতার মুক্তি মানবজীবনের সব ব্যাপ্তি-প্রাপ্তির মূল উৎসভূমি হিসেবে দেখেছেন, তেমনি প্রতিটি গীতিকবিতার পঙ্ক্তিতেও ভাষা-স্বাধীনতা এবং দেশপ্রেমের ফসল বুনেছেন। দেশমাতৃকার প্রতি কবির অগাধ ভালোবাসা, মমত্ববোধ এবং কৃতজ্ঞতা ছাড়াও বাংলার জনপদের বহুমাত্রিক প্রতিচ্ছবিই প্রতিভাত হয়েছে এসব গীতিকবিতায়। বলা যেতে পারে, কবির গীতিকবিতাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলা-মায়ের চিরন্তন চিত্রলিপি হিসেবেই স্ফূর্তি পেয়েছে।

কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুর আগে রচিত একটি গীতিকবিতার সুরকার ছিলেন সমর দাস (১৯২৫-২০০১)। এটি হলোÑ

স্থায়ী : স্বর্ণলতায় ঝর্ণাতলায় দোলন-চাঁপার গাছে, আমি প্রতিদিন তোমাকেই দেখি/দেখি হৃদয়ের কাছে।

অন্তরা : স্বদেশ আমার তোমার দু’চোখে/কী মায়া দেখি যে আনন্দ-শোকে/বোঝাতে পারি না সে ভাষা আমার/চোখের তারায় নাচে।

সঞ্চারী : যে ফুল ফোটাও ধূসর-ধুলায় প্রাণ মাতে তার গন্ধে/যে নদী বহাও উদ্দাম স্রোতে নেচে উঠি তার ছন্দে।

আভোগ : নিত্য তোমার রূপের ছায়ায়/কত যে কাহিনি কবি খুঁজে পায়/তোমার মাঝে ফসলের ঘ্রাণে/জীবনেরই গান আছে।

গীতিকবিতাটি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই চেতনার বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে দেশ-মাতৃকাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন কবি। গীতিকবিতাটির বাণীর বর্ণিল ছটা প্রেম-প্রকৃতির ক্যানভাসে উদ্ভাসিত, তা শ্যামল বাংলার চিরচেনা রূপ। এতে স্পষ্ট হতে পারে, কবি গণমুখী গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই সাহিত্যচর্চায় ব্রতী ছিলেন। বাংলার হাজার বছরের গীতিকবিরা লোকজধারায় গীতিকবিতা লিখেছেন আবার সুরারোপও করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০)। লালন ফকিরের গীতিকবিতায় চিরায়ত লোকজ মানসিকতা এবং সংগ্রাম স্পষ্ট। এই ধারায় আরো রয়েছেন পাঞ্জু শাহ, শীতলাং শাহ, কালু শাহ, বিজয় সরকার, মুকুন্দ দাস, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ। এদের বিপ্লবাত্মক সৃজনী নিগৃহীত, শোষিত শ্রেণিকে যুগে যুগে মন্ত্রণা দিয়েছে। কিন্তু কবি শামসুর রাহমান জীবন-জগৎকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পেছনের সঙ্গে ছেদ ঘটিয়েছেন। ভাষায় এনেছেন লালিত্য, বর্ণনায় প্রকৃতি ও জীবনের বিচিত্রধর্মী চিত্রকল্প। সমাজের অসংগতিও তার গীতিকবিতায় ফুটে উঠেছে। শিল্পী-লেখক বাবু রহমানের মতে, ‘তার নির্মিত শব্দে চন্দনরূপী জ্যোৎস্না, মেঠো বাঁশি আমাদের রঙিন গোঠে নিয়ে যায়। যে কীর্তন আমাদের একদিকে উচ্চাঙ্গসংগীত, অন্যদিকে গ্রামীণগীতির সার্থক সংমিশ্রণ সেই কাহিনি হয়ে ওঠে আমাদের হৃদয়ের ছবি। শব্দের ঠাঁস বুনুনি নেই, আছে মাঝে মাঝে শব্দের ঝিলিক। রাধা-কৃষ্ণের রূপারূপ, মান-অভিমান, গোঠে গোচারণ সহজিয়াভাবে শ্রোতার সামনে উপস্থাপিত হয়েছে তার গানে।’

কবি শামসুর রাহমানের কবিতাভা-ার সমৃদ্ধ থাকলেও ‘গীতিকবিতা’ কম লিখেছেন। তার গীতিকবিতার সংখ্যা শতাধিক। এর পরও এসব গীতিকবিতা বাংলা গানের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে। কবির গীতিকবিতায় মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম ওতোপ্রোত। বাংলা গীতিকবিতার গতানুগতিক ধারা এড়িয়ে তিনি ভিন্নভাবে বাণী লিখেছেন বলেই শ্রোতারা পেয়েছেন নতুন স্বাদ। কবির শব্দ চয়নের মুনশিয়ানা তাকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। বাণীর বিচিত্ররূপের বিশেষ ব্যবহারে বাংলা গান হয়েছে আরো সমৃদ্ধ। চর্যাপদ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলা গীতিকবিতার দীর্ঘ পথপরিক্রমা এবং ত্রিশোত্তর কবিদের থেকে কবিতার বাঁক-বদল এবং চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের শিল্পবাস্তবতায় শামসুর রাহমান যে স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা তার কবিতা এবং গীতিকবিতায় সমভাবে উজ্জ্বল। কবি শামসুর রাহমানের কবিত্বশক্তির গৌরবও এখানে নিহিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close