সোহেল নওরোজ

  ১৭ জুলাই, ২০২০

আপন বয়ানে হুমায়ূন

বাংলা সাহিত্যের একটা নতুন ধারা সৃষ্টি করে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। যে ধারায় আরোপিত বিষয় একেবারেই নেই। বাহুল্য বা আড়ম্বর হুমায়ূন-সাহিত্যের অনুষঙ্গ নয়; বরং জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতির মায়াবী চিত্রায়ণ তার মুখ্য অলংকার। হুমায়ূন আহমেদ মূলত গল্প বলে গেছেন আটপৌরে জীবনের, একেবারে নিজের মতো করে, মুখের ভাষায়। কখনো তা উপন্যাসের কাঠামো লাভ করেছে, কখনো থেমে গেছে গল্পে। লেখালেখির বাইরেও নাটক-সিনেমা বানিয়েছেন, সেখানেও জীবনের বহুমুখী গান। হুমায়ূনের স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে হয় এ কারণে যে, তার সৃষ্ট চরিত্রের মতো তিনি নিজেও ছিলেন খেয়ালি, অননুমেয়। হুমায়ূন সারাজীবন কলমকে ইন্দ্রিয় বানিয়ে সৌন্দর্যের সন্ধান করে গেছেন। তার লেখায় সৌন্দর্যের উপকরণের ছড়াছড়িÑ এই মেঘ, ঝুম বৃষ্টি, নদী, সমুদ্র, গাছপালা, চান্নিপসর রাত, বাঁধভাঙা জোছনা, মানুষের মায়া-মমতা, প্রেম, কোমলতা...।

হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শোনা যায়। তিনি নিজেকে ‘সাধারণ’ দাবি করেই লিখে গেছেন। বেশির ভাগ সাহিত্যিকই তার মতো অকপট নন বলে হয়তো একটু আলাদাই মনে হবে লেখালেখি সম্পর্কে হুমায়ূনের ভাবনাÑ ‘বেশির ভাগ সময় আমি নিজের আনন্দের জন্য লিখি। শুনতে খারাপ লাগলেও লেখার সময়টা অসম্ভব ভালো লাগে। আমি খুব সাধারণ লেখক এবং আমার লেখার পুরো ব্যাপারটাই স্বতঃস্ফূর্ত। অনেক লেখক বসে দীর্ঘক্ষণ চিন্তাভাবনা করেন, এই করব, সেই করব; সেটা আমার মধ্যে নেই।’ তবে কি লেখালেখিটাকে তিনি হালকাভাবে নিয়েছিলেন? কখনোই নয়। এটা ছিল তার সহজাত ব্যাপার। ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস লিখেছিলেন এক রাতে! প্রকাশক কলেবর আরেকটু বাড়াতে বললে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন অতি নাটুকেপনা তার পছন্দ নয়! কেবল সৃজনশীলতা চর্চার জন্য এ মুল্লুকে অধ্যাপনার মতো লোভনীয় পদ আর কেউ ছাড়তে পারে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি লেখালেখিকে কতটা গুরুত্ব দিতেন, তা ব্যাখ্যা করার জন্যই বলেছিলেনÑ ‘লেখালেখি এক ধরনের থেরাপি। ব্যক্তিগত হতাশা, দুঃখবোধ থেকে বের হয়ে আসার পথ। আমি এই থেরাপি গ্রহণ করে নিজের মনকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করি।’

ব্যক্তি হুমায়ূনকে খুঁজে পেতে হলে তার সৃষ্টকর্মের কাছেই ফিরে যেতে হবে। বাইরে যতটা কঠিন, ভেতরে ঠিক ততটাই কোমল। দেখলেই রগচটা মধ্যবয়স্ক কোনো শিক্ষক মনে হবে, যার প্রধান কাজ ছাত্রদের বেত্রাঘাত করা; অথচ সেই তিনিই আবার আড়ালে গিয়ে কৃতকর্মের জন্য অঝোরে চোখের পানি ফেলেন! এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। ঠিক যেন অবুঝ একটা শিশু লুকিয়ে আছে মনের গভীরে। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রগুলো কাটাছেঁড়া করলে এমনটিই প্রতিভাত হয়। তিনি নিজের ছায়াকেই নানাভাবে চরিত্রগুলোর মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন। সে কথা স্বীকার করে বলেছেনÑ ‘আমি পুরোপুরি বানিয়ে সাধারণত কিছু লিখি না।’

হিমু না মিসির আলিÑ কে বেশি জনপ্রিয়?Ñ বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে এ এক অমীমাংসিত ধাঁধা! নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর সঙ্গে তার চরিত্রের সাযুজ্য কতখানিÑ এ ব্যাপারে অবশ্য মুখ খুলেছিলেন তিনি নিজেই, ‘হিমুর কাজকর্ম রহস্যময় জগৎ নিয়ে। সে চলে এন্টি-লজিকে। বেশির ভাগ সময় বাইরে ঘোরে। রাত জেগে পথে পথে হাঁটে, কিন্তু সে-ই সবচেয়ে বেশি অন্তর্মুখী। অন্যদিকে মিসির আলি চোখ বন্ধ করে পৃথিবী দেখেন। হিমু চোখ খোলা রেখেও কিছুই দেখে না। একসময় আমি এদের সৃষ্টি করেছিলাম। কিন্তু এখন এরা আমার পুরো নিয়ন্ত্রণে নেই। এদের ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এরাই বরং এখন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার সত্তার ৩০% হিমু, ৩০% মিসির আলি। বাকি ৪০% কী, আমি জানি না। জানতে চাইও না।’

ফিকশন লেখকদের সবচেয়ে বড় সম্পদ বোধহয় সাধারণ ঘটনাকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা। হুমায়ূন আহমেদ এ কাজে এত বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন যে, তার গল্পগুলোকেই সত্যি বলে মনে হয়। জীবনের ঘটনা বর্ণনা করার সময়েও তার এ স্বভাবের হেরফের হয়নি। তার সাক্ষাৎকার, আড্ডা বা আত্মজৈবনিক রচনাগুলোও তাই সমান রসালো। আমরা জানি, প্রচুর সিগারেট খেতেন হুমায়ূন আহমেদ। সিগারেটকে তার সবচেয়ে ‘কাছের বন্ধু’ বলেও উল্লেখ করেছেন। সেই সিগারেট খাওয়ার শুরুর ঘটনা হুমায়ূন বলেছেন এভাবেÑ ‘ঢাকা কলেজে পড়ার সময় হোস্টেলের নিয়ম ছিল প্রতিটি ছাত্রকে একবার করে বাজার করতে হবে। আমিও গেলাম একবার বাজার করতে। আমার সঙ্গে গেল দুই বাবুর্চি। বাজারে গিয়ে তারা আমার হাতে একটা ক্যাপস্টান সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, আপনি সিগারেট খান। বাজারের আপনি বুঝেন কী? আমরা বাজার করে নিয়ে আসি। আমি মহানন্দে সিগারেটে টান দিলাম এবং আমার মনে হলো, যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি।’

লেখক হিসেবে যাত্রা শুরুর ঘটনা আরো মজার। তিনি স্বভাবসুলভভাবে বলেছেনÑ ‘তখন আমি চিটাগাং কলিজিয়েট স্কুলে পড়ি। স্কুল ম্যাগাজিনে একটা গল্প ছাপা হয়েছিল। গল্পটি ছিল আমার বাবার লেখা, নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছি।’ এটুকু পড়ে থেমে গেলে বড্ড ভুল হবে। হুমায়ূন-চরিত্রের আসল মজা এর পরের কথায়Ñ ‘আসলে হয়েছিল কীÑ পড়ি ক্লাস সেভেনে। স্কুল ম্যাগাজিনে গল্প দিতে হবে। একটা ভূতের গল্প লিখেছি। বাবা বললেন, দেখি কী লিখেছিস? আমি বাবার হাতে গল্প দিলাম। তিনি বললেন, অনেক কারেকশন লাগবে। কলম দে। কলম দিলাম। বাবা গল্প কাটাকাটি করে ছেড়াবেড়া করে দিয়ে বললেন, কপি করে আন। আমি কপি করে তার কাছে দিলাম। তিনি আবার শুরু করলেন কাটাকুটি। তৃতীয় দফায় কাটাকুটির পর যা অবশিষ্ট রইল, সেটা আর যাই হোক আমার গল্প না।’ তার লেখায় এই হিউমারের তুমুল ব্যবহার দেখে অনেকেই নাক সিঁটকান। হুমায়ূন রাখঢাক না রেখে নিজের অবস্থান তুলে ধরেনÑ ‘আমাদের প্র্যাকটিক্যাল লাইফে আমরা ক্রমাগত নানা রকম ঠাট্টা করছি, তামাশা করছি, হাসছি, রসিকতা করছি। কিন্তু যখনই লিটারেচারে চলে আসি, তখন দেখি আমরা সবাই গম্ভীর হয়ে যাই। মনে হয় জীবন থেকে রসবোধ উঠেই গেছে! আমরা খুবই দরিদ্র, তার পরও প্রচুর হাসতে পারি এবং হাসতে পছন্দ করি।’ জীবন আর সাহিত্যকে আলাদা করে দেখতে চাননি কখনোই। লেখার উপকরণের জন্য জীবনের কাছেই হাত পেতেছেন বারবার।

মৃত্যু নিয়ে প্রচুর ভাবতেন হুমায়ূন আহমেদ। তার রচনায় ‘মৃত্যু’ ব্যাপারটা ঘুরেফিরে এসেছে। অবধারিত বিষয়টিকে অস্বীকার না করে বলেছেনÑ ‘এটা আসবেই। যাদের বয়স কম তাদের এই ভাবনা কম আসে, যাদের বয়স বেশি তাদের বেশি আসে। তরুণদের দেখে মনে হয়, তাদের বোধহয় মৃত্যু নেই! কিন্তু ৫৫ বছর ক্রস করলেই মনে হয় আর তো সময় নেই। আমার অবশ্য অনেক আগে থেকেই মনে হয়। সুন্দর কোনো কিছু দেখলেই মনে হয়, মাই গড! কয়েকদিন পরই তো এই জিনিস আমি আর দেখব না।’

সত্যিই তাই! এখনো আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, পুকুরে ব্যাঙ ডাকে; অনেকেই মুগ্ধ হয়ে দেখেন, দেখেন না এগুলো দেখতে শেখানো মানুষটিÑ আমাদের সাহিত্যের রাজকুমার হুমায়ূন আহমেদ!

কেমন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ? কেমন জীবনযাপন করতেন তিনি? তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মতো কি রহস্যময় এবং খেয়ালি ছিলেন? মানুষকে হুহটাট চমকে দিতে পছন্দ করতেন? লেখালেখির বাইরের জীবনেইবা কতটা রসিক ছিলেন?Ñ এসব নিয়ে পাঠকের কৌতূহলের অন্ত নেই। এই লেখায় ব্যক্তি হুমায়ূনকে খুঁজে পাওয়া গেছে তারই বয়ানের বিশ্লেষণে। বিভিন্ন সময়ে লেখার মধ্যে, সাক্ষাৎকার, কথোপকথন বা আড্ডায় নিজের সম্পর্কে চমকপ্রদ অনেক কথা অকপটে বলেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সেগুলোর নির্যাসে তার প্রয়াণবার্ষিকীর এই আয়োজন

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close