হাফিজ উদ্দীন আহমদ

  ১৩ মার্চ, ২০২০

ভ্রমণ

কাটি সার্ক

উঠছি আর উঠছি। ওঠার যেন শেষ নেই। উঠতে উঠতে হাঁটুর ১২টা বেজে যাচ্ছে। কানে এখনো অনুরণিত হচ্ছে কাল গ্রিন পার্ক আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করা সেই সুদর্শন তরুণের গলা। সে কারো কাছে পয়সা চাইছে না। সামনে একটি পাত্র রাখা। তাতে খুশি মনে কেউ কিছু দিয়ে যাচ্ছে। সুরেলা কণ্ঠে অজান্তেই পা আটকে গেছিল কিছুক্ষণ। ভাবলাম, এত সুন্দর একজন গায়ক কেন রাস্তায় ভিখারির মতো গান গায়? সে তো স্টেজ পারফরম্যান্স করে দেশ মাতিয়ে দিতে পারে, হয়তো জীবনে সবার সুযোগ আসে না। বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলোকে ঝলমল করছে সবুজ গ্রিনউইচ পাহাড়। তার চূড়ায় পৌঁছতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১৫৪ ফুট। ওপর থেকে লন্ডন শহরের অনেকটা দেখা যায়। পাহাড়ের সঙ্গে এমনিতে একটা আলাদা ভালোবাসা আছে, কিন্তু উঠতে গিয়ে যে কষ্ট হয়, তাতে ভালোবাসা ফুরিয়ে যেতে থাকে।

আকাশ পরিষ্কার। ঝকঝকে সবুজ প্রকৃতি। বিলাতে আসার পর থেকেই পাখির মতো উড়ছি। এখন রয়্যাল অবজারভেটরি ও টাইমলাইন মিউজিয়াম দেখতে এসেছি। প্রথমে কাটি সার্ক দেখতে গিয়েছিলাম। ১৮৬৯ সালে তৈরি ঐতিহাসিক দ্রুতগামী ব্রিটিশ ক্লিপার শিপ এটা। গ্রিনউইচ রয়্যাল মিউজিয়ামেরই অংশ এ শিপ। এটা দিয়ে এশিয়া থেকে মুখ্যত চা আনা হতো ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে। আবার অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ডে উল আনা হতো বলেও শোনা যায়। ফটকের কাছে উৎকীর্ণ : ওয়েল কাম টু কাটি সার্ক। পাশেই লেখা সকাল ১০টায় খোলে বিকাল ৫টায় বন্ধ। অনলাইনে টিকিট কেনা যায়। ভেতরে ক্যাফে আছে। রয়েছে সমুদ্রের জীবন বর্ণনা আর নানা সামুদ্রিক প্রদর্শনী। পালতোলা জাহাজ ছিল এটা। প্রথম যাত্রাতেই ঘটেছিল দুর্বিপাক। মাত্র ২৩ বছর বয়সে দক্ষ নাবিক রবার্ট ফিশার আমাশয়ে মারা গিয়েছিলেন। সেকালে ভালো চিকিৎসা ছিল না। ঘুরে ঘুরে জাহাজের মাস্টার রুম, কেবিন, ডেক, পাটাতন, ইঞ্জিন ঘরের সব যন্ত্রপাতি, জাহাজের স্টিয়ারিং, ছাদে পুরোনো বটগাছের শেকড়ের মতো ঝুলে থাকা পাল টাঙানোর নানা রকম দড়ি, কাটি সার্ক জাহাজের ক্ষুদ্রকায় মডেল ইত্যাদি দেখলাম। ডেক, পাটাতন, কেবিন, ছাদ সর্বত্রই প্রদর্শনী। এক কেবিনে বিরাট পিয়ানো। তাতে লেখা : পিয়ানো ফ্রম সিডনি। অন্যত্র বিশাল একটি গ্লোব। পাশে ইংরেজিতে অনুরোধ করা হয়েছে গ্লোবটি ছুঁঁয়ে কাটি সার্ক সাংহাই থেকে লন্ডনে চা এবং সিডনি থেকে লন্ডনে উল যে পথে নিয়ে যেত তা দেখার জন্য। কিছু দূরে অস্ট্রেলিয়ান উলের নমুনা রাখা। লেখা আছে কাটি সার্ক যে উল বোঝাই করে আনত তা দিয়ে ১,২৫০,০০০ সুয়েটার বানানো সম্ভব ছিল। ডেকের এক মাথা বেশ উঁচু। সেখানে ছোট মই দিয়ে উঠতে হয়। এক প্রান্তে এসে আমি ও প্রেটি ছবি তুললাম। পেছনে নীলাভ জল। প্রেটির গায়ে নীল চেকের কোট। চমৎকার লাগছে তাকে। ঘুরতে ঘুরতে পেলাম কেরোসিন কাঠের বিরাট বাকসো। লেখা : কাটি সার্কস কার্গো। ওতে করেই চা নেওয়া হতো মনে হচ্ছে। ডেকের ওপর ঝুলছে একটি বড় হলুদ রঙের ঘণ্টা। হয়তো বিপদ-আপদে সবাইকে একত্রিত করা হতো তা বাজিয়ে। আরেক জায়গায় সাজিয়ে রাখা পিতলের বেল। দেখতে মেগা সাইজের ল্যান্ড টেলিফোনের মতো। বেলটার ইতিহাস লেখা পাশে। জাহাজটি একসময় পর্তুগিজদের কাছে বিক্রয় করা হয়। সে সময়কার পর্তুগাল টাইমস পত্রিকায় খবরটি হেডলাইনে ছাপা হয়। নতুন নাম দেওয়া হয় ফেরিরা (Ferreira) ও জাহাজটি যখন পর্তুগিজদের অধীনে ছিল তখন কাটি সার্কের এক পুরোনো অফিসার ১৯০৩ সালে তা চুরি করে। পর্তুগিজ নাবিক তখন পাশে থাকা বার্ক শেক্সপিয়র জাহাজের বেল চুরি করে সে স্থানে লাগায়। ১৯২২ সালে ক্যাপ্টিন ডাওম্যান কাটি সার্ক ক্রয় করলে সেই চোর আসল বেলটি ফেরত দিয়ে শেক্সপিয়রের বেলটি ফেরত নিয়ে যায়।

জাহাজটির স্থানে স্থানে আরো বিচিত্র সব তথ্য লেখা। ব্রিটিশরা তাদের অতীতের ভুলভ্রান্তি ও কালিমার কথা অকপটে স্বীকার করে, ইতিহাসকে বিকৃত করে না তার প্রমাণ পেলাম ফলাও করে লেখা ওপিয়াম ওয়ার পড়ে। সংক্ষেপে লেখা সে ইতিহাস। ১৮৪২ সাল পর্যন্ত চীন গুয়ানডং ও ম্যাকাও দিয়ে চা রফতানি করত বিলাতে রৌপ্যের বিনিময়ে। এই রৌপ্য ফেরত পাওয়ার জন্য ব্রিটিশরা মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চোরাকারবারি দ্বারা বিপুল পরিমাণ আফিম জোরজবরদস্তি করে ভারতে বিশেষত বর্তমান বাংলাদেশে উৎপন্ন করে চীনে পাঠাত তাদের নেশাগ্রস্ত করার জন্য, যাতে সে দেশের বিপুল জনগণ তা কিনে রৌপ্যের বিনিময়ে। আজ ইংল্যান্ডসহ পৃথিবী মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে অথচ ইংরেজরাই এ নেশাকে বাণিজ্যের খাতিরে ছড়িয়ে দিতে সেকালে এরূপ ঘৃণ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। চীন এটাকে প্রতিরোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় এবং এর ফলে ব্রিটিশদের সঙ্গে পরপর দুটো যুদ্ধ হয়, ১৮৩৯-৪২ সালে প্রথম আফিম যুদ্ধ ও ১৮৫৬-৬০ সালে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে হংকং ব্রিটিশদের দখলদারিতে চলে যায়।

কাটি সার্কের পরতে পরতে ইতিহাস কথা বলছে। এক জায়গায় দেখতে বিউগলের মতো পিতলের কথা বলার চোঙা, প্রাচীন দুরবিন ও বায়ুচাপ মানযন্ত্র শোভা পাচ্ছে। পাশে লেখা ক্যাপ্টেন উডগেট ১৮৮৫-৯৫ সালে এ জাহাজের মাস্টার বা অধ্যক্ষ ছিলেন। এ জিনিসগুলো তার। বেশ কিছু দূরে একটি পদক সজ্জিত। একটি গোলাকার পিতলের বড় ফুলের মাঝখানে একটি নীল বলয় আর তার কেন্দ্রে দৃষ্টিনন্দন ধাতব তারকা। তৎকালীন ভারতের শীর্ষস্থানীয় জাহাজের চিহ্ন এটা। গোড়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উইলিস জাহাজের জন্য তৈরি হয়েছিল এ প্রতীক বোম্বেতে। একসময়ের দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন ডাওম্যানের ছবি দেয়ালে। মে ১৯৫৩-তে ডিউক অব এডিনবার্গ এসেছিলেন জাহাজ পরিদর্শনে। তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছিল, সে ছবিও আছে। অন্যত্র জাহাজে কেবিনের দেয়ালে উৎকীর্ণ : ১৮৭৭ সালে সব জাহাজকে পেছনে ফেলে কাটি সার্ক সবার আগে চা নিয়ে লন্ডনে পৌঁছে। মাত্র ৯টি পালের জাহাজ সে বছর যাত্রা করেছিল। অথচ ১৮৭০ সালে ছিল ঊনষাটটি জাহাজ কেননা ধীরে ধীরে বাষ্পীয় জাহাজগুলো সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তার করছিল, ফলে পালের জাহাজ কমে যাচ্ছিল। একসময় বাষ্পীয় জাহাজগুলোর দাপটে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী এ পালতোলা জাহাজ বন্ধ হয়ে ইতিহাসে স্থান লাভ করে। এক জায়গায় চাঁদের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে : জাহাজটি মোট ৯৫৭৯৯৫ নটিক্যাল মাইল সফর করেছিল অর্থাৎ যে দূরত্ব অতিক্রম করলে চাঁদে গিয়ে আবার ফেরত আসা যায়। টাইটানিক ও কাটি সার্ক দুটোই বিখ্যাত জাহাজ। টাইটানিকের কথা আমরা সবাই জানি, কেননা তা মর্মান্তিকভাবে ডুবে গিয়েছিল; কিন্তু কাটি সার্কের খবর অনেকেই জানি না, কেননা সেটা কখনোই ডুবেনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close