মামুন মুস্তাফা

  ১৩ মার্চ, ২০২০

কবর ও জসীম উদ্দীন

রবীন্দ্র প্রভাব বলয়মুক্ত বাংলা কবিতা লেখার অভিপ্রায়ে কল্লোল গোষ্ঠীর আবির্ভাব। এই কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে তিরিশের দশকে কবিতার আধুনিকতা নির্মাণ করলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে। এর সমসাময়িকে আরো অনেকেই ছিলেন তাদের অন্যতম হচ্ছেন সমর সেন। ঠিক ওই সময়ে কল্লোল গোষ্ঠীর তালিকায় অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববাংলা থেকে আরো এক কবি যুক্ত হলেন, তিনি জসীম উদ্্দীন। কিন্তু কল্লোল পত্রিকার প্রথম দুই সংখ্যায় তার কবিতা ছাপা হলেও তা তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। তবে কল্লোলের তৃতীয় সংখ্যায় ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক মহল থেকে শুরু করে সাহিত্যের বিদগ্ধজনরাও নড়েচড়ে বসলেন।

কিন্তু কী এমন সম্মোহনী শক্তি ছিল ‘কবর’ কবিতার? যে কারণে কবির ছাত্রাবস্থায় কবিতাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য বাংলা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়! এটি শতাধিক চরণের এক দীর্ঘ আখ্যান কবিতা। শোকবিহ্বলচিত্তে পিতামহ তার একমাত্র দৌহিত্রকে দাদি, বাবা-মা, ফুফু ও বড় বোনের কবর দেখিয়ে অতীত স্মৃতি বর্ণনা করে চলেছেন। মানুষ মাত্রই এ কবিতায় আবেগ আপ্লুত হবে, সন্দেহ নেই। বারংবার মৃত্যুকথা এর শোকাবহ আবহটিকে একঘেয়ে করে তোলেনি শুধু কবির অসাধারণ উপস্থাপনার কারণে। মৃত্যুর মুহুর্মুহু উপস্থাপনা সত্ত্বেও এখানে সংযম ছিল, সরলতার পাশাপাশি ছিল আবেগী তীব্রতা। আর কবিতার ভাষায় ছিল প্রমিত বাংলার সঙ্গে কিছু আঞ্চলিক শব্দের সার্থক প্রয়োগ। এর ছন্দ ও অলঙ্কারও শাদামাটা, কেবল আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ‘কবর’ কবিতাকে পাঠকের মর্মমূলে গেথে দিয়েছে। ‘সচেতন অলংকরণের প্রয়াস থেকে নিবৃত্তি, আবেদনের প্রত্যক্ষতা এবং আঞ্চলিক স্বাদগন্ধÑ গোবিন্দচন্দ্র দাসের আঞ্চলিক আবহের চেয়েও কিছু অধিকÑ কবিতাটিকে আলাদা করে দিয়েছিল বাংলা কবিতার মূলধারা থেকেÑ তা সে রাবীন্দ্রিক বা আধুনিক যা-ই হোক না কেন।’ (জসীম উদ্্দীন, আনিসুজ্জামান)

কিন্তু তার পরও কবি হিসেবে জসীম উদ্্দীন নিজেকে আধুনিকতার কাতারে নিয়ে যেতে পারেননি। ‘পল্লী কবি’-এর তকমা দিয়ে তাকে ‘আউট সাইডার’ করে রাখা হয়েছে। জসীম উদ্্দীন মূলত বাংলার শ্যামল গাঁয়ের জলমাটিহাওয়া ও তার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে আধুনিক সময়ের জাঁতাকলে উন্মেচিত করতে চেয়েছেন।

খন্ড কবিতা ও কাহিনিকাব্যÑ এই দুই ভাগে জসীম উদ্্দীনের সমগ্র কাব্যপ্রয়াসকে চিহ্নিত করা চলে। কবির প্রথম কাব্য রাখালী খন্ড কবিতার গোত্রভুক্ত। অপরদিকে নকশি কাঁথার মাঠ বা সুজন বাদিয়ার ঘাট কাহিনিকাব্য হিসেবে পরিচিতি পায়। আর এসব গ্রন্থই চিরকালীন আধুনিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই রাখাল’র সূচিতে ঠাঁই করে নেয় ‘কবর’ কবিতা। এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের প্রশংসাতিলক কপালে নিয়েও উত্তরকালের সমালোচক কবি হিসেবে জসীম উদ্্দীনকে আধুনিকতার পঙ্ক্তিতে তুলে আনতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন কেন, তা আজ প্রশ্নসাপেক্ষ। জসীম উদ্্দীনের কবিতার বিষয় মূলত প্রেম ও মাতৃস্নেহ, প্রকৃতি ও পল্লীজীবন, জনজীবনস্পর্শী সামাজিক ঘটনা ও রাজনীতি। এ ছাড়াও তার কবিতায় আমরা দেখি, গ্রামীণ বাংলার শ্যামল প্রকৃতির শান্ত ও উজ্জ্বল উপস্থাপন; আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ রূপ; গ্রামীণ উৎসব ও প্রাচীন কোনো স্মৃতিনিদর্শনের হার্দ্যকি বর্ণনা; স্বদেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আলেখ্য। এ থেকেই বোঝা যায়, কবি হিসেবে জসীম উদ্্দীন তার সময়, সমাজ ও মানুষ থেকে বিযুক্ত ছিলেন না। বরং সমসাময়িকতাকে ধারণ করেছেন তার কবিতার আখ্যানে। আর আঞ্চলিক শব্দের সঙ্গে প্রচলিত ছন্দ ও প্রমিত ভাষার সমন্বয়ে এক নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে কবি জসীম উদ্্দীন সক্ষম হন। যা তাকে তার সময়কালের অন্য কবিদের থেকে আলাদা বিশিষ্টতায় চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।

‘কবর’ কবিতায় বৃদ্ধ পিতামহ একমাত্র জীবিত দৌহিত্রকে তার প্রেমময়ী স্ত্রী, উপযুক্ত পুত্র, লক্ষ্মী পুত্রবধূ, আদরের নাতনি এবং স্নেহের পুত্তলী মেয়ের বিয়োগান্তক বিদায়ের কথা জানাতে গিয়ে এক দুর্বিষহ মরুময় জীবনের দুঃস্বপ্নকে বর্ণনা করেছেন। এক দুঃসহ বেদনায় তার অস্তিত্বকে বহন করে বেঁচে থাকার অপরাধ বোধের গ্লানি তিনি ব্যক্ত করতে চান। আর তাই দিন-রাত মৃত্যু কামনা তার সব ভাবনাকে তাড়িত করেÑ ‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে/অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে’।

বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিকের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি ও হৃদয়ানুভূতির সার্থক সমাবেশে ‘কবর’ কবিতাটি দুর্লভ শিল্পসার্থকতার অধিকারী। পল্লী বৃদ্ধের দুঃসাহস বেদনার চিত্র যেন সব পল্লিবাসীরই মর্মবেদনার এক স্থানিক চিত্র। এই বৃদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলার পাড়াগাঁয়ের সব অশীতিপরের যুগ-যুগান্তের পুঞ্জীভূত শোক-বেদনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘কবর’ কবিতায়। ব্যক্তিগত সুখ এখানে সব মানব-অন্তরের শোকবিহ্বল চেতনাকে প্রকাশ করেছে। বাংলা কাব্যে সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ-বেদনার এমন মহিমাময় শিল্পসম্মত প্রকাশ খুব একটা নজরে আসে না। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ‘কবর’ কবিতাকে বাংলা কবিতার নতুন দিগদর্শন বলে চিহ্নিত করে এর অনন্য সৃষ্টি-মহিমারই স্বীকৃতি জানিয়েছেন।

আর হুমায়ুন কবিরের মতে, ‘দেশের গণমানসের অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাব্যে রূপান্তরিত করতে পারাই জসীম উদ্্দীনকে কাব্যসিদ্ধি দিয়েছে। কিন্তু সে শক্তি পশ্চাৎমুখী বলে তা নতুন নতুন রাজ্যজয়ে অগ্রসর হতে পারেনি’ (জসীম উদ্্দীন, আনিসুজ্জামান)। হুমায়ুন কবিরের বক্তব্যকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার না করেও আমরা বলতে পারি, বাংলা কবিতায় জসীম উদ্্দীন একটি স্বতন্ত্র পথ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। লোক ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং ঐতিহ্য থেকে বিষয়য়বস্তু ও জীবনাচরণকে পুঁজি করে তিনি নতুন ধারার কবিতার নবজন্ম দিয়েছেন। কবি তার খন্ড কবিতাগুলোতে লোকাচারের প্রত্যক্ষ পরিচয়কে এবং সমাজের সাধারণ স্তরের সঙ্গে একাত্মতার মাধ্যমে রূপদান করেছেন বাংলা কবিতার একটি নতুন ধারার।

‘কবর’ কবিতায় যে বেদনাবিধুর আর্তি ধ্বনিত হয়েছে, তা কেবল গ্রামীণ জনপদের নয়; বরং এ সব সময়ের আধুনিক-অনাধুনিক, উঁচু-নিচু, বালক-বৃদ্ধÑ সবার। কবিতাটির আবেদনও তাই কাল-পাত্র-পরিবেশ ছাপিয়ে বিশ্ব-চরাচরে গৃহীত হয়েছে মানব-অন্তরের গভীর অনুভূতির আয়নায়। আবহমান গ্রামবাংলার চিরপরিচিত চিত্র ও প্রসঙ্গ রূপায়ণ করতে গিয়ে জসীম উদ্্দীন প্রেম ও রোমান্টিকতার মোহময়তা নির্মাণ করেছেন সুকৌশলে, বাস্তব অভিজ্ঞতার স্নিগ্ধ আলোয়। তার এই পরিচয় সব মহলে প্রতিষ্ঠিত। গ্রামীণ জীবনের গীতলতায় নিমগ্ন, সৌন্দর্য ও প্রেমভাবনা চিত্রনে সাবধানি কবি জসীম উদ্্দীনকে আমরা নতুনভাবে আবিষ্কার করি তার কবিতার কথামালায়। আর তাই স্বকীয় ধারায় আপন গতিপথে কাব্যস্রোত প্রবাহিত করে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন ১৯০৩ সালে ফরিদপুরের তাম্বুলখানায় জন্ম নেওয়া, বাংলা সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি জসীম উদ্্দীন।

এ কথা সর্বজনবিদিত, গ্রামজীবনের প্রতিচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি জসীম উদ্্দীন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানববোধকে লালন ও সমৃদ্ধ করেছেন। তবে এও সত্য, স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল জসীম উদ্্দীনের কাব্য-পরিসরের যথার্থ মূল্যায়ন তার সময়কালে যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, তেমনি উত্তরকালের পাঠক-বিশ্লেষকরাও তার মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। মানতে দ্বিধা নেই, মানবপ্রীতি আর জীবন-সংকটের সঙ্গে একাত্ম যে জসীম উদ্্দীন, তাকে আমরা হারাতে বসেছি ‘পল্লীকবি’ পরিচিতি ব্যাপ্তির বেড়াজালে। অথচ ‘কবর’ কবিতা সূচিভুক্ত করে কবির প্রথম কাব্য রাখালী (১৯২৭) প্রকাশের পরপরই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথসহ আরো অনেক সুধিজনের প্রশংসা লাভে সমর্থ হয় এই কবিতাগ্রন্থটি।

যদিও কবি জসীম উদ্্দীন গাঁয়ের রূপরসগন্ধ সহকারে সেই জনপদের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, আনন্দ-বেদনার কথা বুনেছেন কবিতায়, তবু তার কবিতায় উপজীব্য হয়ে ওঠে সব কালের সব মানুষের প্রতিচ্ছবি। আর তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যেমন ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায় তার কবিসত্তাকে খন্ডিত করা হয়; তেমনি ‘পল্লীকবি’ বিশেষণে জসীম উদ্্দীনকেও খন্ডিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুখপাত্র। অথচ তার প্রতিবাদী প্রবল কণ্ঠস্বরটি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরেই রয়ে গেল আজ অবধি। ‘সন্দেহ নেই জসীম উদ্্দীন একজন আদর্শনিষ্ঠ খাঁটি বাঙালি বড় কবি। তিনি যুগের কবি ছিলেন না বটে, কিন্তু জাতির কবি।’ তার কবিতায় বাঙালি জাতিসত্তার যে বীজ রোপিত, তা বাংলা কাব্যসভায় অনন্য সাধারণ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close