নিজস্ব প্রতিবেদক
বাজার অস্থির, বেড়েছে তেল-চিনির দাম
সপ্তাহখানেক আগে ডিম ও মুরগির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। কাগজে কলমে দাম বেঁধে দিলেও বাজারে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। উল্টো বেঁধে দেওয়ার পর ডিমের ডজনে ১০ টাকা ও মুরগির কেজিতে বেড়েছে ১৫ টাকা। এক লাফে চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫-৬ টাকা। পাম অয়েলের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি ১৮ টাকা। যদিও এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর স্থিতিশীল। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কয়েকটি গ্রুপ বাজার অস্থিতিশীল করছে। প্রশাসন শক্ত হাতে সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে বাজারের অস্থিরতা কাটবে না।
ক্রেতারা বলেছেন, ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর চাঁদাবাজি কিছুটা কমলেও গোপনে চলছে লেনদেন। ফলে চাল-চিনি-পাম অয়েল কিংবা ডিমণ্ডমুরগিই নয়, আলু-পেঁয়াজ ও সবজি-মাছসহ প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামই বাড়ছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সমন্বিত তদারকি না থাকায় পাইকার, মধ্যস্বত্বভোগী ও খুচরা বিক্রেতা সবাই বাড়তি মুনাফা করছে। নিয়মণ্ডকানুন না মেনে বিভিন্ন পণ্য অবৈধভাবে মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। সমন্বিত তদারকি না থাকায় সরবরাহ ও মজুতের সঠিক তথ্য কেউ জানাতে পারছে না। যা বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়মক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিগত সময়ের মতো বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের কারও সঙ্গে বাজার সিন্ডিকেটের কোনো আঁতাত নেই। তাই বাজার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সারা দেশে পথ-ঘাট ও পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি ঠেকাতেও সরকার সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আগাম ঘোষণা দিয়েছে। ফলে বাজার তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন নয়।
বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যেই বাজারে নামলেও জনবল সংকটে থাকা এ সংস্থাটি পর্যাপ্ত অভিযান চালাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বিএসটিআই, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং টিমের বাজার তদারকি করার কথা থাকলেও বাজারে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দেখা নেই। বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, সব সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি একসঙ্গে বাজার তদারকি এবং বাজারে অভিযান পরিচালনা করত, তাহলে অনায়াসে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, বাজার তদারকির বেশ কয়েকটি সংস্থা আছে। সংস্থাগুলো পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সেরকম কাজ করছে বলে মনে হয় না। মাঝেমধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তরের টিমকে বাজার তদারকি করতে দেখা যায়। ঠিকমতো বাজার তদারকি না করায় পণ্য মজুদ রাখা, অতি মুনাফার চিন্তা থেকে ব্যবসায়ীদের বিরত রেখে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা যাচ্ছে না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে তারা অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে, কারসাজি করে পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছে।
তবে সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই ডিমণ্ডমুরগির দর নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারে সংকট না থাকার পরও দাম বাড়ায় কারা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যদিও কেউ কেউ বলেছেন, তদারকির কাজে যুক্ত- এমন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। তবে বাজারে তদারকি চলমান।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, ডিম মুরগির দর নির্ধারণের সময় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং পোলট্রি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপে প্রতিনিধি রাখার দরকার ছিল। অসাধু মজুদদারদের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দাম বেঁধে দিয়ে কখনোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তদারকি না করলে বাজার আরো অস্থির হয়ে উঠবে এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এ সুযোগ নেবে।
এদিকে দুর্বল তদারকি ও সমন্বয়হীনতার সুযোগে চালের বাজার আবার লাগামহীন হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ মোকাম নওগাঁর মহাদেবপুরসহ অন্যান্য মোকামে আউশের ভরা মৌসুমেও দফায় দফায় চালের দাম বাড়ছে। আর মোকামে চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে। এতে বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চালের দাম কেজিতে ২-৩ টাকা, মাঝারি চালের দাম কেজিতে ৩-৪ টাকা এবং চিকন চালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। খুচরা বিক্রেতারা বলেছেন, মোকামে দাম বৃদ্ধির কারণে খুচরা বাজারে দাম বাড়ছে। আর মোকামের চালকল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দাম বাড়ছে।
বাংলাদেশ অটোরাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান বলেন, ‘চালের দাম কেন বাড়ছে, জিজ্ঞাসা করলে ব্যবসায়ীরা বলবে বাজারে ধান কম, তাই চালের দাম বেড়েছে। বন্যার কথাও বলবে তারা। কিন্তু আসল ঘটনা অন্য জায়গায়। এখন বাজারে ধান কম থাকলেও ধান আছে উত্তরাঞ্চলের চাতাল মালিকদের কাছে। তারা আগেই ধান কিনে স্টক করে রেখেছে। এখন তারা সুযোগ পেয়ে দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটছে। সর্বোচ্চ ৩০ জন চাতাল মালিক এটা নিয়ন্ত্রণ করছে।
এদিকে গত ৫ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ আমদানিতে বিদ্যমান ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর আলুর ক্ষেত্রেও আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার পাশাপাশি ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে বাজারে আগের মতো উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে এ দুটি পণ্য। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকা দরে। আর প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে।
"