নাটোর ও লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
অস্ত্র জমা দেননি পলক, শিমুল ও তাহেরপুত্র টিপু
নাটোরে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক, সাবেক সংসদ সদস্য শিমুল ও লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সাবেক আলোচিত মেয়র প্রয়াত আবু তাহেরের ছেলে এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু।
নাটোরে নিজেদের নামে লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র¿ দেননি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং জুনাইদ আহমেদ পলক ও নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের আলোচিত সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া সময় পার হলেও সাবেক এই দুই এমপির পক্ষে কেউ সংশ্লিষ্ট থানায় এ অস্ত্র জমা দেননি। ফলে এই দুজনের অস্ত্র অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে সরকার।
নাটোর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ের জুডিশিয়াল মুন্সিখানা (জেএম) সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত নাটোরের ৭টি থানায় নির্ধারিত শর্তের অনুকূলে ৯৫ জন ব্যক্তিকে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় এসব অস্ত্রের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপিসহ জনপ্রতিনিধি ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা নিজেদের নিরাপত্তায় নেন। গত ২৫ আগস্ট এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অনুমোদিত এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও ব্যবহৃত গোলাবারুদ জমা দিতে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে বৈধ লাইসেন্সধারীরা অধিকাংশই মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে নাটোরের ৭টি থানায় ৮৯টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নামে দুটি বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময় শেষে তা জমা পড়েনি। বর্তমানে গ্রেপ্তার থাকা পলকের এই অস্ত্র দুটি কোথায় আছে, তা কেউ জানেন না। পলকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাসহ নিকটজন হিসেবে পরিচিত সিংড়ার আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও বাড়িঘর ছেড়ে পলাতক রয়েছেন। ফলে এই অস্ত্রের ব্যাপারে কেউ কিছু জানাতে পারেনি। অন্যদিকে ৫ আগস্ট দুপুরে সরকার পতনের খবরের কিছুক্ষণ আগে নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান নাটোর-২ আসনের আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। তিনি পালানোর খবরে তার বাড়ি জান্নাতি প্যালেসে আগুন দেয় উত্তেজিত জনতা। তারপর থেকে পালিয়ে আছেন শিমুল। বাড়িছাড়া শিমুলের ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও। ফলে শিমুলের নামে লাইসেন্স করা দুটি অস্ত্র তিনি নিজে বা অন্য কেউ জমা দিতে আসেননি। এমপি পলক ও শিমুল ছাড়াও নিজেদের নামে থাকা একটি করে অস্ত্র জমা দেননি পলকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত সিংড়া পৌরসভার মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস ও শিমুলের ব্যবসায়িক অংশীদার আশফাকুল ইসলাম। তবে গত ১ সেপ্টেম্বর নাটোর শহরের কারবালা মোড়ে একটি পরিত্যক্ত পুকুর পাড় থেকে একটি অস্ত্র, দুটি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এ বিষয়ে নাটোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরুর ঠিক আগে নাটোর শহরে ফেলে রাখা একটিমাত্র অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। আমরা আমাদের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি-অস্ত্রটি আশফাকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির। তার নামে আরো একটি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে তিনি বা তার প্রতিনিধি কর্তৃক জমা না দেওয়ায় অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।’ নাটোর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মারুফাত হুসাইন বলেন, ‘যে ছয়টি লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্র জমা পড়েনি, তাদের মধ্যে দুটি করে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক ও এমপি শিমুলের। ফলে এখন এগুলো অবৈধ বলে ঘোষিত হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথবাহিনী কাজ করছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে, সে লক্ষ্যে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু অস্ত্র জমা দেননি। তিনি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সাবেক আলোচিত মেয়র প্রয়াত আবু তাহেরের ছেলে।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনকে ঘিরে গত ৪ আগস্ট সংঘর্ষে পুরো লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। টানা চার ঘণ্টা শিক্ষার্থী-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন ও তার বাহিনী। অভিযোগ রয়েছে সালাহ উদ্দিনের অস্ত্র থেকেও সেদিন গুলি ছোড়া হয়। এতে ৪ শিক্ষার্থীসহ ১২ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত শতাধিক। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন গুলিবিদ্ধ।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, ওই দিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বাসভবনের ছাদের ওপর থেকে টিপু ও তার লোকজন আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করেন। এতে ৪ জন শিক্ষার্থীসহ ১২ জন নিহত হন। শতাধিক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের হত্যার ঘটনায় সালাহ উদ্দিন টিপুকে প্রধান আসামি করে মামলা করা হয়।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে আওয়ামী লীগের সালাহ উদ্দিনসহ অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপন করেন। জেলা প্রশাসনের জে এম শাখার তথ্যমতে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরে জেলা প্রশাসন ব্যক্তিমালিকানা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করে ৩৫টি।
এসব লাইসেন্সের বিপরীতে ৩৫টি আগ্নেয়াস্ত্র কেনা হয়। কিন্তু গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন থানায় জমা পড়েছে ৩৪টি আগ্নেয়াস্ত্র। জমা পড়া অস্ত্রের মধ্যে পিস্তল ১৫টি, শটগান ১৭টি, বন্দুক ১টি ও রাইফেল ১টি। অবশিষ্ট ১টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়েনি। সেটি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহ উদ্দিনের অস্ত্র। গত মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেওয়ার সর্বশেষ সময় নির্ধারণ করা ছিল।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লাইসেন্সের বিপরীতে কেনা ১টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেননি। এখন সেসব অবৈধ হয়ে গেছে। এ কারণে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে মাঠে নেমেছে যৌথ বাহিনী।
"