নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩

৮ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি

চিকিৎসাসেবায় আস্থার অভাব, ব্যয়ও বেশি

সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। সবশেষ প্রকাশ করা বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যয় হিসাবের তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৯ শতাংশ রোগী নিজের পকেট থেকেই খরচ করে। এর কাছাকাছি খরচ হয় আফগানিস্তানে, সেখানে ৬৪ শতাংশ। আর মালদ্বীপে সবচেয়ে কম ১৮ শতাংশ।

আবার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ আছে। সরকারি ও বেসরকারি সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতি বছর বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে যায়। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে অবস্থাপন্ন মানুষ। অর্থে কুলালে আরো বেশি মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেত বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে চিকিৎসাসেবার মানে আস্থা না থাকায় মানুষ বিদেশে যাচ্ছে।

বিশ্বে স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মানসম্পন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, নার্সসহ ২৩ জন স্বাস্থ্যকর্মীর একটি দল থাকা দরকার। বাংলাদেশে ৮ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি আছে। দেশের প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৩ দশমিক ৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি মানসম্পন্ন সেবার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেছে, নানা অজুহাতে ৪০ শতাংশ চিকিৎসক অনুপস্থিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপস্থিত স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসকের পক্ষে বিপুলসংখ্যক রোগীকে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।

যদিও হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল ছাড়া রোগীরা অন্য হাসপাতালগুলোতে জরুরি চিকিৎসাসেবা পায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর জন্য বেশি সময় দেন না। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দেশের মানুষের একটি বড় অংশ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসা ও হাসপাতালগুলোর অতি মুনাফালোভী কর্মকাণ্ডে স্বাস্থ্যসেবায় আস্থা হারাচ্ছে দেশের মানুষ।

দক্ষিণ এশিয়ায় শিশু জন্মদানে সবচেয়ে বেশি সিজারিয়ান হয় বাংলাদেশে। সর্দি, কাশি, জ্বরের মতো সামান্য অসুখেও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। চিকিৎসকরা রোগীদের ঠিকভাবে না দেখা, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে না শোনা, ব্যবস্থাপত্রে প্রয়োজনের বেশি ওষুধ লেখা, ভুল ওষুধ লেখা- এমন নানা অভিযোগ রয়েছে রোগীদের। রোগ নির্ণয়ের অজুহাতে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে বলেন চিকিৎসকরা। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অপচিকিৎসায় কঠোর কোনো শাস্তির নজিরও এ দেশে নেই।

ঢাকা বিশ্বেবিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে। ফলে আমরা সবাই টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছি। আর এ জন্য যেখানে সুবিধা পাবে, সেই সুবিধাটুকু সে নেবে। এটা সরকারি হাসপাতাল হোক কিংবা বেসরকারি হোক। তিনি বলেন, জনবল সংকটের কারণে সরকারি হাসপাতালে সেবা সহকারীরা কোনো সার্ভিস দেয় না। চিকিৎসকরা ভালো থাকলেও হাসপাতাল স্টাফরা প্রতিষ্ঠানগুলো কুক্ষিগত করে রেখেছে। ফলে সার্ভিস পেতে দালাল, নার্স এবং আয়াদের পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। আর রোগীর চাপ বেশি থাকায় চিকিৎসকরা রোগীকে যতটুকু সময় দেওয়ার কথা তা দেন না।

অধ্যাপক আবদুল হামিদ আরো বলেন, চিকিৎসকদের কাজ করার যে ধরনের পরিবেশ প্রয়োজন সেটাও নেই। ফলে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মানুষকে সঠিক সেবা দিতে গেলে পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। তাই জাতীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে ১ নম্বর গুরুত্বপূর্ণ সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী সব মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

পুরো স্বাস্থ্য খাত চলে মূলত এক ধরনের অ্যাডহক কার্যক্রমের ভিত্তিতে। অর্থাৎ যখন যা প্রয়োজন তার ভিত্তিতে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ধরনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি। ফলে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। যদিও আমাদের মাতৃমৃত্যু, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং অধিক সংখ্যক মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

তবে স্বাস্থ্যসেবায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও সাধারণ মানুষ এখনো কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, একটা দেশে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা কেমন হবে তা নির্ভর করে সরকারের নীতি ও কৌশলের ওপর। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের স্বাস্থ্য সেবার জন্য একটি পরিপূর্ণ নীতি কাঠামো এবং কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি।

এদিকে, সবশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ। জনগণের কত ভাগ সরকারি সেবা পাবে আর কত ভাগকে বেসরকারি সেবা দেওয়া হবে তা বিবেচনায় নিয়ে সেবার মান নিয়ন্ত্রণ ও বিকাশ এবং জনবল নিয়োগের পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি।

এ বিষয়ে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বেসরকারি খাতে চিকিৎসার মান কেমন হবে তার জন্য পর্যবেক্ষণ জরুরি। যেমন চিকিৎসার মান কেমন, লজিস্টিক সাপোর্ট এবং অন্য জনবল কতটুকু আছে এমনকি সেবা মূল্য কেমন হবে তা সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা দরকার, যা করা হয়নি। ফলে এ জায়গায় তদারকি বাড়াতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close