নিজস্ব প্রতিবেদক
শিশু ধর্ষণ বাড়ছে বিচারহীনতায়
দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। আইন, প্রচার, সচেতনতা কোনো কিছুই কাজে আসছে না। আর এই ধর্ষণের ঘটনায় বিচারও পাওয়া যাচ্ছে না। ধর্ষকরা যেন অপ্রতিরোধ্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবার এবং পরিচিত পরিবেশেই শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিশুদের ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন। আর এই শিশুরা পরবর্তী জীবনে দুঃসহ মানসিক এবং শারীরিক কষ্ট নিয়ে বেড়ে উঠছে।
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম জানায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৪ কন্যাশিশু। এছাড়া যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরো ৭৬ কন্যাশিশু। এই শিশুরা পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সের। তবে অধিকাংশের বয়সই ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ধর্ষণের বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার বিধি থাকলেও কার্যকর হয় না। জাতীয় কন্যাশিশু
অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, এটা পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। সামাজিকসহ নানা কারণে অনেক ঘটনায়ই মামলা হয় না। অনেক ঘটনা প্রকাশও করা হয় না।
এদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, ২০২১ সালে সারা দেশে ৮১৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ৩১ শতাংশ বেশি। বেশির ভাগ শিশু ধর্ষণের ঘটনা পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের মাধ্যমেই হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তারাও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতেই এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
এ বছরের প্রথম আট মাসে গড়ে ৭২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা হারের দিক থেকে ২০২১ সালের চেয়ে বেশি।
অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, সোমবার গাইবান্ধায় পাঁচ বছরের একটি শিশুকে ৫৫ বছর বয়সের এক পুরুষ ধর্ষণ করেছে। এর আগেও সে আরো তিনবার ধর্ষণের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছে। ছাড়া পেয়ে আবার ধর্ষণ করেছে। তাহলে এটা থেকেই বোঝা যায় শিশু ধর্ষণ কেন বাড়ছে। আইন আছে, বিচার নেই। আবার শিশুরা পরিচিত পরিবেশে, পরিবারের মধ্যেই ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। এটা অনেক সময়ই প্রকাশ হয় না। প্রকাশ হলেও নানা দিক বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত আপস হয়। ফলে শিশু ধর্ষণ বাড়ছেই।
জলি আরো বলেন, শিশুরা সবচেয়ে দুর্বল। তারা বুঝতেও পারে না। পরিবার থেকে এ ব্যাপারে তাদের সচেতনও করা হয় না। আর পরিবারের লোকজন পরিচিতদের বিশ্বাস করে। যার পরিণতি নেমে আসে শিশুদের ওপর।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, ২০১৪ সালের জরিপে দেখা যায় ধর্ষণের ৬০ শতাংশ ঘটনায় থানায় কেউ অভিযোগ করে না। ২০১৬ সালে দেখা যায় মেয়েদের ৮০ শতাংশ মামলা করতে যায় না। যে যত বেশি দুর্বল তারাই তত বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। তাই শিশু এবং প্রতিবন্ধীরা ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। আর পরিচিত পরিবেশ এবং পরিবারের মধ্যে ধর্ষণ বেশি হওয়ার কারণ ধর্ষক জানে এই পরিবেশে শিকার বানানো সহজ। সে এটার সুযোগ নেয়।
ওয়াহিদা বানু বলেন, পারিবারিক শিক্ষা এর জন্য জরুরি। শিশুকে বিষয়টি বুঝাতে হবে। আর তারা আগে মায়ের কাছেই বলে। মা-ও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় তা প্রকাশ করেন না। থানা মামলা নিতে চায় না। আর মামলা নিলেও বিচার পাওয়া যায় না। উচ্চ আদালতে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির ১১ লাখ মামলা ঝুলে আছে। আর নারীদের করা নানা ধরনের মামলা আছে ৩৩ লাখ। ধর্ষণের শিকার এই শিশুদের সারাজীবন এর নেতিবাচক প্রভাব বহন করতে হয়। তারা নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার শিকার হয়। আবার সমাজ ও পরিবারেও তারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থাকে। এটা শুধু আইনের মাধ্যমে দূর করা যাবে না। সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আনতে হবে।
"