নিজস্ব প্রতিবেদক
ভোগাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
দাম বাড়তি, পণ্য কিনতে জমানো টাকায় হাত

সংকটের শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে। তখন অনেকের আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি বিপদ হয়েছিল মধ্যবিত্তের। সেই ধাক্কা সামলে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম ভোগাচ্ছে মানুষকে। এখন অনেকেই জমানো টাকায় হাত দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে, নতুন করে বেড়েছে মাছের দাম। ইলিশের দাম কিছুটা কমলেও এখনো নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। সস্তার তালিকায় থাকা তেলাপিয়া-পাঙ্গাশের দামও বাড়তি। মাছ কিনতে গিয়ে ক্রেতারা নাখোশ। এ ছাড়া চাল-ডাল, আটা-ময়দা, সয়াবিন তেলেও নেই স্বস্তি। অন্যদিকে হঠাৎ করে বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে খোলা চিনি। তবে কোনো বাজারে প্যাকেটের চিনি মিললেও দাম চড়া। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ৬ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি চিনি। তবে সংকটের জন্য দাম বেঁধে দেওয়ার জটিলতাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
আবার সপ্তাহের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে প্রতি কেজি ১০ টাকা করে। এ ছাড়া আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও তার প্রভাব নেই চালের বাজারে। ৫৩ টাকার নিচে মিলছে না মোটা চালও। বাড়তি ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দামও। প্রতিটি ফার্মের মুরগির ডিম কিনতে হচ্ছে ১২ টাকায়। আর ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা দরে।
শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর রামপুরা, উত্তর বাড্ডা ও সারুলিয়া বাজার ঘুরে জানা গেছে, চাল, তেল, মাছ, মাংসসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যা কয়েক দফা দাম বাড়েনি।
মুরগি সেই চড়া দামেই : আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের মুরগি। ব্রয়লার প্রতি কেজি ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা, সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা ও দেশি মুরগি ৪৬০ থেকে ৪৮০ টাকা। কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের মেসার্স মা আয়েশা ব্রয়লার হাউসের ব্যবসায়ী মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ‘সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির বাজারে কোনো পরিবর্তন আসেনি। মুরগির খাদ্যের বাড়তি দাম এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে মুরগির দাম কমার সম্ভাবনা কম। ’
চাল-আটায় স্বস্তি নেই : সপ্তাহের ব্যবধানে আবার বেড়েছে আটার দাম। প্রতি কেজি খোলা আটা পাঁচ টাকা বেড়ে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত আটা আগের বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। দুই কেজি ওজনের আটার প্যাকেট ১২৫ টাকা। চাল আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। মোটা ব্রি ২৮ চাল প্রতি কেজি ৬০ টাকা, মিনিকেট বলে পরিচিত চিকন চাল প্রতি কেজি ৭৫ টাকা ও নাজিরশাইল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি। চিকন মসুরের ডাল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি। মোটা মসুরের ডাল ১০০ থেকে ১১০ টাকা। আমদানি করা আদা প্রতি কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, দেশি আদা ১২০ টাকা। আমদানি করা রসুন ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা ও দেশি রসুন ৯০ থেকে ১০০ টাকা। পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৪৫ টাকা, আলু প্রতি কেজি ৩০ টাকা। ডিম আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ডজন ডিম ১৪৫ টাকা।
বেড়েছে সবজির দাম : সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে কয়েকটি সবজির দাম পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। গোল বেগুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা, লম্বা বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা, দেশি শসা ৮০ টাকা, পটোল, ঢেঁড়স, চিচিঙ্গা প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বাঁধাকপি ৫০ টাকা, ছোট ফুলকপি ৫০ টাকা, শিম ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, কাঁচামরিচ ৮০ টাকা, টমেটো ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, গাজর ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ অবস্থায় মানুষের সঞ্চয়ে টান পড়ছে মূলত মূল্যস্ফীতির চাপে। জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী জাকির হোসেন বলেন, তার বাবা বেচে নেই। পরিবারে স্কুলপড়ুয়া সন্তান রয়েছে দুজন। সঙ্গে আছেন মা ও ছোট ভাই। সব মিলিয়ে ৬ জনের সংসার। তাই বাধ্য হয়ে বাবার ব্যাংকে জমা টাকা থেকে প্রতি মাসে খরচ করতে হচ্ছে। এভাবে চললে বাবার টাকাও তো একসময় শেষ হয়ে যাবে।
একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মুহতাসিন মাহমুদ বললেন, ‘আমার যে বেতন, ব্যাগ ভরে যদি এক দিন বাজার করি তো এক ধাক্কায় বেতনের অর্ধেক টাকা শেষ।’
আমানত এভাবে কমতে থাকলে ব্যাংক খাতের তারল্যে চাপে পড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। সে রকম হলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিতে পারে। সুদহার নিয়ন্ত্রণ করা ব্যাংকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে তখন।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকে আমানতের সুদের হার এখনো মূল্যস্ফীতির নিচে। ফলে মানুষ দুই পয়সা লাভের আশায় অন্য কোথাও সঞ্চয় সরিয়ে ফেলতে পারে। শোনা গেছে অনেকে ডলারেও বিনিয়োগ করেছেন। এটি খুঁজে দেখা প্রয়োজন আসলে টাকা গেছে কোথায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে ৯৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত যোগ হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩০ দশমিক ৪১ শতাংশ কম।
গত বছরের জুন শেষে দেশে ব্যাংক খাতে সঞ্চিত আমানত ছিল ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। এক বছরের মাথায় এ বছরের জুন শেষে তা বেড়ে ১৪ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা হয়। কিন্তু জুলাই মাসে তা কমে ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এক মাসে ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ কমেছে ৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা।
"