সোহেল রানা, পলাশবাড়ী (গাইবান্ধা)

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

নকশিপল্লীর সফল নারী পলাশবাড়ীর শেফালী

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী পৌরসভার উদয়সাগর গ্রামের রেজাউল ইসলামের স্ত্রী শেফালী। বি আরডিপি অফিস থেকে নকশি বিষয়ে প্রশিক্ষন নিয়ে শেফালীর জীবনে এসছে সাফল্য ও পরিবর্তন। উদ্যোক্তা হয়ে নিজের ভাগ্য বদলিয়ে এখন অন্যের ভাগ্য বদলাতে পাশে দাড়িয়েছেন সফল এই নারী উদ্যোক্তা।

জানা গেছে, ১৯৯০ সালে সপ্তম শ্রেনিতে লেখাপড়া চলাকালীন পলাশবাড়ী পৌরসভার উদয়সাগর গ্রামে রেজাউল ইসলামের সাথে বিবাহ হয় শেফালীর। স্বামী বেসরকারী কোম্পানীতে চাকরি করেন। স্বামীর রোজগারে সংসার চলতো না। ঘরে শেফালীর তিন ছেলে মেয়ে। অভাব-অনাটনের সংসার চালানো ও ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ ব্যয়ভার নেওয়া কঠিন ছিল। ২০১৮ সালে উপজেলা বি আরডিপি অফিস থেকে নকশীকাঁথা ও এমব্রয়ডারির প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। প্রশিক্ষন নিয়ে উপজেলা বি আরডিপি অফিস প্রথমে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি। পরে তাকে আবারও দেড় লাখ টাকা ঋন প্রদান করা হয়। ওই টাকা নিয়ে শেফালী প্রথমে তার বাড়ীর আশেপাশের ১৫-২০ জন নারী মা, ভাবী, বোনদের নিয়ে নকশীকাঁথা সেলাই শুরু করেন। এরপর নকশীকাঁথা বিক্রির জন্য বগুড়ায় নকশীকাঁথা বিক্রয়ের মার্কেট খুজে পান এবং ওই মার্কেটে প্রথমে ৫টি নকশীকাঁথা প্রত্যেকটি ২ হাজার টাকা দরে ক্রয় করতে রাজি হলে শেফালীর কাজের মনযোগ আরও বেড়ে যায়। শেফালীর নকশীকাঁথার প্রসার ঘটাতে গ্রামের গৃহবধু, বিধাব নারী, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, শিক্ষার্থীসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া ৭৫ জন নারীকে উপজেলা বি আরডিপি অফিস থেকে এমব্রয়ডারী সেলাই প্রশিক্ষন দিয়ে তার নকশীপল্লী নকশীকাঁথার কাজে যোগদান করান। নকশীকাঁথা সেলাই করতে ৪ থেকে ৬ জন করে একটি দল গঠন করে দেন। প্রত্যেককে সংসারের সব কাজ সম্পন্ন করে নকশীকাঁথা সেলাই করে নিজের ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করছে। এখন শেফালীর নকশীপল্লীতে প্রায় ২০০ জন নারী হাতের কারুকাজ করছেন।

নকশীপল্লীকে এগিয়ে নিতে উপজেলা বি আরডিপি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান নকশী কাঁথার সৌন্দর্য, কাজের মান ও বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন করে বানানোর পরামর্শসহ সহযোগীতা করে আসছেন। তৈরি পণ্য গুলো হচ্ছে, বকুলকাঁথা, স্বদেশীকাঁথা, কার্পেট কাঁথা, লহরীকাঁথা, ভরাটকাঁথা, জামাই সোহাগী কাঁথা, জোর সামুক কাঁথা, সাধারণ কাঁথা, কাঁথা স্টেটেস এর কাঁথা, এপ্লিকেটস বেডসীড, পাটিসেলাই, শাড়, ও থ্রী পিচ, নকশি চাদর, সোপার কৃশন, কৃশন কভার।

একটি নকশীকাঁথা কারু কাজ করে তৈরি করতে সময় লাগে ১৫-২০ দিন। প্রত্যেক নকশীকাঁথার রকমভেদে পারিশ্রমিক পান ৩-৭ হাজার টাকা। পাইকারী একেকটি নকশীকাঁথা রকমভেদে বিক্রয় করা হয় ১-৯ হাজার টাকা। আর এসব নকশীকাঁথা যাচ্ছে ঢাকা মোহাম্মদপুর আড়ং ও ঢাকা নিউ মার্কেটে।

পৌরসভার গৃধারীপুর সরকারপাড়া গ্রামের সুফল মিয়ার স্ত্রী সেতুমনি বলেন, আমি সংসারের সকল কাজ সেরে ওইখানে নকশীকাঁথার কাজ করি। যে টাকা আয় করি তা দিয়ে সংসারের ছোট-খাট চাহিদা নিজেই মিটাই। একই গ্রামের শাহাজাহান এর স্ত্রী শান্তনা বেগম বলেন, আমিও গৃহিনী সব কাজ শেষ করে এখানে এসে কাজ করি যা পাই তা দিয়ে নিজের ও বাচ্চার চাহিদা মিটাতে পারি। পৌরসভার উদয়সাগর গ্রামের বিএ ৩য় বর্ষের ছাত্রী উম্মে কুলসুম হীরা বলেন, প্রশিক্ষন নিয়ে এখানেই নকশীকাঁথার কাজ করছি। এখান থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ চালাই।

পৌরসভার উদয়সাগর মুন্সিপাড়া গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা নুরুন্নাহার বলেন, আমি বাবার বাড়ীতে থাকার সুবাদে শেফালী আপার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখানে নকশীকাঁথার কাজ করছি। এখান থেকেই আমি রোজগার করছি আর তা দিয়ে চলছি।

উদ্যোক্তা শেফালী বেগম জানান, গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা বি আরডিপি অফিস থেকে এমব্রডারী ট্রেডে প্রশিক্ষণ নেই। ঋণ নিয়ে নকশীকাঁথা সেলাই এর কাজ শুরু করি। পরে আমাকে অফিস কাজ বাড়ানোর জন্য আবারও ঋণ প্রদান করেন। বর্তমানে আমার এখানে প্রায় ২০০ জন নারী কাজ করেন। উপজেলা বি আরডিপি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান স্যারের পরামর্শ ও সব সময় কাজের মান বাড়াতে সহযোগীতা করছেন।

পলাশবাড়ী উপজেলা বি আরডিপি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রিুত প্রকল্প। গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের পণ্য ভিত্তিক পল্লী গঠন করা এটির মূল লক্ষ্য। এটি আমরা কাজের মাধ্যমে এলাকার সম্ভবতা যাচাই করে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত, বিধাব নারী, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সমিতি গঠনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং উদ্যোক্তা তৈরি করি। স্বাবলম্বী হতে তাদেরকে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা, কাজে সহায়তা, পণ্য বাজারে বিক্রিতে সংযোগ তৈরি করে দেই।

ইউএনও কামরুজ্জামান নয়ন বলেন, শেফালী নকশী পল্লীর কাঁথা সেলাইয়ের মাধ্যমে খুব ভাল করছেন। অন্যান্য উদ্যোক্তারাও বেশ ভাল করছেন। তারা ঋণ চাইলে তাদের কার্যক্রম বাড়াতে প্রশাসনিকভাবে সহযোগীতা করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close