মো. নুরুল করিম আরমান, লামা (বান্দরবান)

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

লামায় বন্যহাতির হামলা ঠেকাতে বনাঞ্চলে বৈদ্যুতিক ফাঁদ

বান্দরবানের লামা উপজেলার বনাঞ্চলে বন্যহাতির আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে এবং ফসলি জমি রক্ষা করতে পেতে রাখা বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে বেঘোরে মরছে বন্যপ্রাণী, এমন কি মানুষও। গত ৩ বছরে এসব ফাঁদে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এছাড়া ৪টি হাতি এবং বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ও সরই ইউনিয়নের সংরক্ষিত এবং অসংরক্ষিত বনাঞ্চলে এমন অসংখ্য বৈদ্যুতিক ফাঁদ ফেতে রেখেছেন স্থানীয়রা। বাড়ি কিংবা ফসলের খেতের চারপাশে তার দিয়ে ঘেরা করে সেখানে বৈদ্যুতিক সংযোগ দিয়ে এ ফাঁদ তৈরি করা হয়। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। হাতিসহ বিভিন্ন পশুপাখিসহ বন্যপ্রাণী মারা পড়ছে। আবার নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাও মরছে। এ সব ফাঁদে হতাহতের ঘটনা বেশিরভাগই ধামাচাপা দেওয়া হয়। তাকে হৃদরোগে বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। দুর্ঘটনার পরপরই এ ফাঁদ তুলে নেওয়া হয় বলে জানান অভিযোগকারীরা।

বন্যহাতির খাবার, আবাসস্থল এবং চলাচলের পথ সংকুচিত হওয়ায় মানুষ এবং হাতির মধ্যে চলছে নীরব লড়াই।

এ বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ইআরটি সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করেও কাজে আসছে না বলে জানান বন কর্মকর্তারা।

লামা বনবিভাগ সূত্র জানায়, লামা বনবিভাগের ৬টি রেঞ্জের আওতায় ১ লাখ ২ হাজার ৮৫৪ একর মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ১৯ হাজার ১৩৫ একর ৬ ধারা ঘোষিত বনাঞ্চল এবং ২ হাজার একর অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চল রয়েছে।

এসব বনাঞ্চলে দুটি দলে ২৫ থেকে ৩০টি হাতি আসে। এসব হাতি চুনতি রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে লামা, ফাঁসিয়াখালী, সরই, আজিজনগর, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, চকরিয়া ফাঁসিয়াখালী, ঈদঘর, উখিয়া টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করে থাকে। আগের বছরের একটা সময় এসব হাতি মিয়ানমারের দিকে থাকলেও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় হাতিগুলো সেদিকে আর যেতে পারছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ে জুম চাষের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস করা, হাতির আবাসস্থল ও করিডোরে চাষাবাদ এবং জনবসতি গড়ে তোলায় খাদ্য সংকটে পড়েছে। এখন খাদ্যের সংকটে হাতি ও মানুষ মুখোমুখি।

লামা ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের (ইআরটি) সাধারণ সম্পাদক মো. ছানাউল্লাহ? বলেন, আগে মানুষ আগুন জ্বালিয়ে, বাজি ফুটিয়ে এবং সবাই মিলে হই-হুল্লোড় করে হাতি তাড়াত। এখন দিন দিন মানুষ বিবেকহীন হয়ে পড়ছে। তারা হাতি তাড়াতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দিচ্ছে। সে ফাঁদে মানুষ, গরু, ছাগল ও পাখি নির্বিচারে মরছে। নিজেদের বাড়ি, ফসল, কিংবা ফলদণ্ডবনজ বাগানের চারপাশে জিআই তার দিয়ে ঘোরাও করে রাখেন। সন্ধ্যার পর এসব তারে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেন। সকালে আবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। অনেক সময় এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা ভুলে যান। এতে নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে মরছেন। অনেকে মারা গেলে তাৎক্ষণিক এসব ফাঁদ লুকিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া কিংবা অন্য কোনোভাবে মারা যাওয়ার নাটক সাজান।

তিনি বলেন, কোনো কৃষকের ১০ হাজার টাকার ফসল নষ্ট হলে বনবিভাগের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পান। তারপরও তারা অমানবিকভাবে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতেন।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের খালখুইল্যা পাড়া, রাঙ্গাঝিরি, চাককাটা, বড় ছনখোলা, কুমারী, বিচুইন্না, ফুটের ঝিরি, বাম হাতির ছড়া, ডান হাতিরছড়া, পাঁচ মাইল, জলপাইতলী, হাইদারনাশী, কবিরার দোকান, ইয়াংছা, ঘিলাতলী, কুরুপপাতা ঝিরি, বগাইছড়ি ও অংসারঝিরিসহ বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতা হয়। এসব ফাঁদে গত ২০২০ সালের জুন মাসে ফাঁসিয়াখালীর ফাইন্না ঝিরি এলাকায় আবদুর রহিম (২১), গত ৩০ আগস্ট ফুটের ঝিরি এলাকায় মো. ইলিয়াছের (৪০) মৃত্যু হয়।

লামা বন বিভাগের প্রধান সহকারী কাজী মো. গোলম ছরোয়ার জানান, বন্যহাতির আক্রমণে নিহত, আহত ক্ষতিগ্রস্তদের সরকার বনবিভাগের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। তিনি জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৩ লাখ ২২ হাজার টাকা, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৭ জনের ফসলের ক্ষতি বাবদ ৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে লামা বন বিভাগের সদর রেঞ্জ অফিসার মো. আতিকুল ইসলাম জানান, হাতি হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা চলমান রয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আমরা বিভিন্ন স্থানে ইআরটি দল গঠন করে সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তবে শুধু সচেতনতা সৃষ্টি করে নয়, বৈদ্যুতিক ফাঁদ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমেই এটা রোধ করা সম্ভব।

এদিকে লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আরিফুল হক বেলাল বলেন, সম্প্রতি উপজেলার সাঙ্গু মৌজায় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close