মো. আতিকুর রহমান, তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ)

  ১৮ অক্টোবর, ২০২১

তাহিরপুরে আরেক ফাঁদ ‘সাব আ সানাবিল’

* কোটি কোটি টাকা নিয়ে উধাও মাওলানা আবদুল আজিজ * প্রতারণার কৌশলে ধর্মীয় অনুভূতি

এবার সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে মানুষের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি পুঁজি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ‘সাব আ সানাবিল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। গ্রামের দরিদ্রদের পাকাঘর ও নলকূপ দেওয়ার কথা বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মওলানা আবদুল আজিজ আল হেলাল এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে এখন উধাও। তিনি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার লইয়ারকুল গ্রামের বাসিন্দা। এর আগে একই কৌশলে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মওলানা আবদুল আজিজ আল হেলাল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার কলাগাঁও গ্রামে বিয়ে করার সুবাদে ওই এলাকায় তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তার ভায়রা এইচ এম ইসমাইল হোসেন একই গ্রামের বাসিন্দা হলেও তিনি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিয়ারচর মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে কর্মরত এবং সেখানেই থাকেন। প্রথম দিকে আল হেলাল সুনামগঞ্জে এলেই ইসমাইল হোসেনকে নিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন গ্রামের মানুষদের কাছে ধর্মীয় কথা-বার্তা বলে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। এভাবে কয়েক দিনের মধ্যেই বিনয়ী আচার-আচরণে ওই এলাকার মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এরপরই শুরু হয় তার প্রতারণার কৌশল। তিনি ওই এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের বলেন, ‘সাব আ সানাবিল সমাজকল্যাণ’ নামে তাদের একটি ধর্মীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি অসহায় লোকদের সাহায্য করা হয়। এখানে ১ লাখ টাকা জমা করলে ৫ লাখ টাকার ঘর পাওয়ার সুযোগ আছে। আর ১০ হাজার টাকা দিলে একটি নলকূপ দেওয়া হবে। তবে এই সাহায্য পাওয়ার একমাত্র শর্ত হলো আবেদনকারীকে অবশ্যই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ও আমলদার হতে হবে। এভাবেই অভিনব প্রতারণার কৌশল ব্যবহার করে হেলাল বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার প্রায় শতাধিক পরিবারের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গাঢাকা দেন। কিন্তু গত ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত কেউই ঘর কিংবা নলকূপ পায়নি। পরে বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিয়ারচর গ্রামের ফালান মিয়া বাদী হয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মওলানা আবদুল আজিজ আল হেলাল, তার বোন আকলিমা আক্তার ও আকলিমার স্বামী রেনু মিয়াকে আসামি করে মামলার করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন।

এ বিষয়ে মিয়ারচর মাদরাসায় শিক্ষক এইচ এম ইসমাইল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি আসলে বুঝতে পারিনি তিনি মানুষের সঙ্গে এমন প্রতারণা করবেন। এখন এলাকাবাসীর সামনে মুখ দেখানোটাও দায় হয়ে পড়েছে। অনেকবার উনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারছি না।

এ বিষয়ে মিয়ারচর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, মাওলানা আবদুল আজিজ আল হেলাল সহজ সরল মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে সবার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সে একজন ভন্ড-প্রতারক। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। যাতে আর কেউ ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা করার সাহস না পায়।

তাহিরপুর উপজেলার কলাগাঁও গ্রামের বাসিন্দা কৃষক লীগ নেতা মোস্তফা মিয়া জানান, আমাদের এলাকার অন্তত ছয়টি গ্রাম থেকে গরিব ও অসহায় মানুষকে ঘর ও নলকূপ দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছে আল হেলাল। টাকা নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই সে উধাও হয়ে গেছে। ফোন বন্ধ থাকার কারণে তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে পারছে না।

দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তারা মিয়া বলেন, দুই উপজেলার প্রায় শতাধিক মানুষ তার প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে। প্রতিটি মানুষই অসহায় এবং দরিদ্র। কেউ জমি বিক্রি করে আবার কেউবা গবাদি পশু বিক্রি করে এই টাকাগুলো দিয়েছে। প্রশাসন উদ্যোগ নিলে হয়তো তারা তাদের দেওয়া টাকা পেতে পারে।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিয়ারচর গ্রামের বাসিন্দা ও মামলার বাদী ফালান মিয়া বলেন, প্রতারণার শিকার হওয়া সবার পরামর্শ ও সম্মতি নিয়ে আদালতে মামলা করেছি। আশা করি শিগগিরই আমরা টাকা ফেরত পাব।

পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার খালেদ-উজ-জামানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা আদালত থেকে মামলাটি তদন্তের ভার পেয়েছি। এরই মধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে আপাতত এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না।

প্রসঙ্গত, এহ্সান গ্রুপের বিরুদ্ধে এমএলএম কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রুপটির প্রধান রাগীব আহসান এবং তার সহযোগী মো. আবুল বাশার খানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব সদস্যরা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, পিরোজপুরসহ ২০টি জেলায় ভুক্তভোগীদের মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, বিক্ষোভ সমাবেশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তোপখানা রোড থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close