নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

আসকের জরিপ

অনলাইনে বন্ধুদের নির্যাতনের শিকার ৩৬% মেয়েশিশু

অনলাইনে ৩৬ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু বন্ধুদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর পরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও আত্মীয় এবং ১৮ শতাংশ অপরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ২৭ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু। ঢাকা ও সাতক্ষীরায় ১৭৮ শিশুর ওপর বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এক ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভায় এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে সংগঠনটি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

‘অনলাইনে শিশু যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও আইনি পর্যালোচনা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় আসকের জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের মধ্যে ৮২ জন ছেলে ও ৯৬ জন মেয়েশিশু ছিল। ৮ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু অনলাইনে যৌন শোষণ, হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সাইবার বুলিং ও যৌন আবেদনমূলক কনটেন্টের মুখোমুখি হয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ শিশু। ২৩ শতাংশ মেয়েশিশু যৌন কনটেন্টের মুখোমুখি হয়েছে। ৪৬ শতাংশ অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব পেয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের ৬৪ শতাংশের বেশির নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। বাকিরা মা বা বাবার ফোন ব্যবহার করে। ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সি ৬৩ শতাংশ ছেলেশিশু মেয়েশিশুদের তুলনায় নিজেদের বেডরুমে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। সভায় পৃথক প্রতিবেদনে শিশুদের অনলাইনে নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিকার পেতে প্রচলিত আইনগুলোর দুর্বলতাও তুলে ধরা হয়।

ইউনিসেফের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ১১ বছর বয়সের আগে ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশ করে দেশের ২৫ শতাংশ শিশু। সভায় বলা হয়, করোনাকালে শিশুদের দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতে হচ্ছে অনলাইন স্কুলে। হোমওয়ার্ক, খেলাধুলা বা বিনোদনের ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনলাইনভিত্তিক। ফলে শিশুরা আরো বেশি হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বা ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে।

মতবিনিময় সভায় আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট ও ৯টি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, ২০১১ সালে ৩৫ জন শিশু অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ২০২০ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ জনে। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৯৯ শিশু অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর ২০১৩ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৩। ২০১৯ সালে মামলা ছিল ৭২১টি। এখন এক হাজারের ওপর মামলা চলমান।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ২০০৮ সালে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ৮ লাখ। এখন সেটা ১১ কোটিতে পৌঁছেছে। সরকার ৩০ হাজার পর্নো সাইট বন্ধ করেছে। ইন্টারনেটে পর্নো সাইট অনুসন্ধানে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে ছিল। এখন বাংলাদেশের অবস্থান ১০০-এর নিচে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউবের যেসব কনটেন্ট পর্নোগ্রাফি বা শিশু পর্নোগ্রাফি বলে মনে হয়েছে, সরকার তা ফেসবুক, ইউটিউবকে অবহিত করা মাত্র তারা তা বন্ধ করে দিচ্ছে।

মন্ত্রী বলেন, শিশুদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বোধশক্তি গড়ে ওঠেনি, তাই ইন্টারনেট ব্যবহারের এই চ্যালেঞ্জ শিশুদের নয়। এই চ্যালেঞ্জ বাবা-মা, শিক্ষক ও সরকারের। নতুন প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব পালনের জন্য সবাইকে ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে, দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে। সন্তানদের চেয়ে অভিভাবকরা প্রযুক্তি দক্ষতায় পিছিয়ে রয়েছে।

বিশেষ অতিথি সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে ভালো ভালো অ্যাপে অভ্যস্ত করতে হবে। অনলাইন ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টিতে আইনগুলো সহজভাবে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রিগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এখন একক পরিবারের সংখ্যা বেশি। অনেক অভিভাবক খোঁজ রাখেন না সন্তান মোবাইল ফোনে কী করে। অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টাল গাইড আছে, তারা সেসব অনুসরণ করতে পারেন। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসপাব) প্রেসিডেন্ট এম এ হাকিম বলেন, বিশ্বজুড়ে এখন ৫০ থেকে ১২০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে পর্নোগ্রাফির। ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে তা অবৈধ মাদক ব্যবসার বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সচেতনতা বৃদ্ধি ও সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এখন বিটিআরসি সাইবার সচেতনতা ইউনিট ও সাইবার ৯৯৯ হেল্পলাইন চালু করতে পারে। তিনি জানান, সরকারের নির্দেশে ইসপাব বিনামূল্যে প্যারেন্টাল নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখলেও এখন পর্যন্ত কোনো অভিভাবক তাদের কাছে সহায়তা চাইতে আসেননি।

জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রামের প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা অ্যান্ড্রু ম্যাকগ্রেগর বলেন, প্রযুক্তির বিকাশে ইন্টারনেট বড় আবিষ্কার হলেও কিছু মানুষ এর অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের যৌন নির্যাতন করছে, প্রতারণা করছে। ঘটনা প্রতিকারে আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

সভায় জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আসকের কর্মসূচি সমন্বয়ক (শিশু অধিকার ইউনিট) অম্বিকা রায় এবং অনলাইনে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দেশের আইনগুলোর পর্যালোচনা বিষয়ক প্রতিবেদন তুলে ধরেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের (স্কুল অব ল) জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close