অরূপ তালুকদার

  ২৬ মার্চ, ২০২১

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

মুক্তিযুদ্ধের আরেক অধ্যায়

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেশপ্রেমিক কর্মী, কলাকুশলী এবং শিল্পীরা শত দুঃখ-কষ্ট, সমস্যা-সংকট আর দুঃসহ অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থেকেও হাসিমুখে পালন করে গেছেন

ধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা-সংগ্রামে এক অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছে এই বেতার কেন্দ্রটি। বলা হয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে দিনরাত এক করে দিনের পর দিন নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের সেই বীরত্বগাথা আর বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সেনাদের গেরিলা অপারেশনে পর্যুদস্ত হওয়ার খবরাখবর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোয় দেশের ভেতরে এবং বহির্বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

পরে প্রমাণিত হয়েছে, এই গুরুদায়িত্ব স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেশপ্রেমিক কর্মী, কলাকুশলী এবং শিল্পীরা শত দুঃখ-কষ্ট, সমস্যা-সংকট আর দুঃসহ অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থেকেও হাসিমুখে পালন করে গেছেন। যদিও তাদের সেই দুঃখ-কষ্ট আর পরিশ্রমের শেষ অবধি ‘শব্দসৈনিক’ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি মিলেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ৪৫ বছর পরে এ সরকারের আমলে। তবে একেবারে না পাওয়ার চেয়ে পরে পাওয়াটাও আমাদের জন্য কম সান্তনার ছিল না।

যদিও স্বাধীনতার পরে এত দিনে আমাদের অনেক শিল্পী ও কলাকুশলী আর জীবিত নেই। তারা তাদের মৃত্যুর আগে স্বীকৃতির সান্তনাটুকুও পাননি। নিঃসন্দেহে এটা ছিল তাদের জন্য ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।

যারা এত দিনে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের আমরা আর কোনো দিনই ফিরে পাব না। তাদের অমলিন স্মৃতিটুকুই শুধু বাংলার মানুষের হৃদয়ের ভেতরে রয়ে যাবে যেমন মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখো শহীদের বীরত্বগাথা অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে ভাস্বর হয়ে আছে প্রতিটি বাঙালির মনে। অনেকেই জানেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্ম হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কলাকুশলীর দুঃসাহসিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। সূচনা হয়েছিল একাত্তরের ২৬ মার্চ। সেই বিদ্রোহী বেতার কর্মীদের নেতৃত্বে ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ সংস্কৃতিমনা বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ এবং তার সহযোগী আবদুল্লাহ আল-ফারূক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, সৈয়দ আবদুস শাকের, মোস্তফা আনোয়ার, রাশেদুল হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, আমিনুর রহমান, শরফুজ্জামান ও হাবিবুর রহমান মনির।

প্রাথমিক পর্যায়ে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন থেকে শুরু হয় এর কার্যক্রম ও নাম দেওয়া হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এখান থেকেই মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঘোষণা প্রচার করা হয়। তবে শুরু হওয়ার কিছুদিন পরে এ নামটি বদলে দেওয়া হয়। ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দিয়ে নতুন নামকরণ করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। এই নামবদলের পেছনে একটু নেপথ্য কাহিনি আছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধান কামাল লোহানী সেই নেপথ্য কাহিনি সম্পর্কে বলেছেন, ‘তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান একাত্তরের ২৭ মার্চ যখন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতে যাবেন তার আগে কি কথায় বা ভাষায় স্বাধীনতার কথা বলবেন সে কথা ভাবতে যেমন সময় নিলেন, তেমনি খসড়া তৈরি করার সময় একা একটি রুমে বসে কী লিখবেন চিন্তা করছেন আর লিখছেন কাগজে কিন্তু পরক্ষণেই তা ছিড়ে ফেলছেন। এমনি করে ঘরের মেঝেটা ছেঁড়া কাগজে একেবারে সাদা হয়ে গেল। অবশেষে একসময় তার লেখা শেষ করলেন কিন্তু রেকর্ড করতে যাওয়ার আগেই বললেন, ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দিতে হবে, না হলে আমি ঘোষণা পড়ব না।’

বেতার উদ্যোগীরা প্রথমে চিন্তায় পড়লেন, পরে বুঝতে পারলেন সামরিক বাহিনীর মানুষ ‘বিপ্লব’ শব্দটি সহ্য করতে পারবেন না। এটাই স্বাভাবিক। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ঠিক আছে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি না হয় বাদই দেওয়া যায়, কারণ দুটো, তাকে দিয়ে ঘোষণাটা দেওয়াতে হবে এবং দ্বিতীয় হলো ‘স্বাধীন বাংলা’ শব্দ তো থাকছেই তাহলে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা না থাকলেও চলতে পারে। সেই থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ হয়ে গেল এবং আমরা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বলতে এবং ব্যবহার করতে শুরু করলাম।’

প্রকৃতপক্ষে, কালুরঘাট থেকে সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী এবং তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও অমানবিক কার্যককলাপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানানো হতো প্রায় নিয়মিত। এর ফলে সেনাবাহিনী হন্যে হয়ে বেতার কেন্দ্রটিকে খুঁজতে থাকে এবং এক দিন সন্ধান পেয়ে বোমাবর্ষণ করে। সেদিন ছিল একাত্তরের ৩০ মার্চ। সম্প্রচার কেন্দ্রটির ওপর বোমাবর্ষণের ফলে ভবনটি বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু সবার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় ছিল, ওই বোমা হামলায় বেতার কর্মী ও কলাকুশলীরা সেদিন কেউ আহত বা নিহত হননি এবং ট্রান্সমিটারটিও অক্ষত ছিল।

এরপর সেই অক্ষত এক কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্যম তরঙ্গের ট্রান্সমিটারটি ট্রাকে নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা আর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিএসএফের সহযোগিতায় আগরতলার সীমান্তবর্তী ‘বগাফা’র জঙ্গলের ভেতরে পুনঃস্থাপন করে। ৪ এপ্রিল থেকে সম্প্রচার শুরু করে দেওয়া হয়। অকুতোভয় তরুণ বেতার কর্মীদের এই দুঃসাহসিক কর্মপ্রচেষ্টা ছিল এক অবিশ্বাস্য ঘটনার ইতিহাস। এভাবে আগরতলায় শুরু হয়ে গিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম।

পরে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পরে ভারত সরকারের সাহায্য-সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নতুন করে স্থাপিত হয় দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি দোতলা বাড়িতে। এখানে আসার ব্যাপারেও একটু ইতিহাস আছে। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যখন প্রথম দেখা করেছিলেন সেই সময় তিনি বিভিন্ন রকম সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছিলেন, যার মধ্যে যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে একটি ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল। সেই প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে আগরতলা থেকে কলকাতায় চলে যান শহিদুল ইসলাম, তাহের সুলতান, আশফাকুর রহমান খানসহ আরো কয়েকজন। তাদের কাছেই দেওয়া হলো বেতার সম্প্রচারের দায়িত্ব। তত্ত্বাবধানে থাকবে প্রবাসী সরকার।

বলা হলো, ২৫ মে, নজরুল-জয়ন্তীর দিন থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হবে। এভাবে অচেনা-অজানা একটা স্থানে তেমন কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই নানা রকম অনিশ্চয়তা আর প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ সূচনা সংগীতসহ শুরু হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিশন।

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি লিখেছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুর দিয়েছিলেন আনোয়ার পারভেজ। সরকারের পক্ষে সম্প্রচার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হলো টাঙ্গাইলের তৎকালীন এমএনএ আবদুল মান্নানকে ও অন্যদের মধ্যে কামাল লোহানী দায়িত্ব পেলেন বার্তা বিভাগের, বেলাল মোহাম্মদ এবং আশফাকুর রহমান খান অনুষ্ঠান এবং সৈয়দ হাসান ইমাম দায়িত্ব পেলেন নাটকের। পরে ইংরেজি অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য পাওয়া গেল চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবিরকে। তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হলো ইংরেজি বিভাগের। পরে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অভিনেতা আলী যাকের। শুরুতে সালেহ আহমদ নামে বাংলা খবর পাঠ করেছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, ইংরেজি খবর আবু নঈম নামে কামাল লোহানী ও পরে সংবাদ পাঠক হিসেবে আসেন বাবুল আখতার, আলী রেজা চৌধুরী, নুরুল ইসলাম সরকার ও ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতেন আবদুল্লাহ আল-ফারূক ও পরে যোগ দেন আলমগীর কবির, আলী যাকের, পারভিন হোসেন, নাসরিন আহমেদসহ দু-একজন।

একসময় উর্দু ভাষা জানা ময়মনসিংহের জাহিদ সিদ্দিকী নামের একজনকে উর্দু বিভাগের প্রধান করে উর্দু জীবন্তিকা প্রচার করা শুরু হয়। প্রচারণামূলক এই জীবন্তিকাগুলো প্রধানত প্রচার করা হতো উর্দুভাষী পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল দুর্বল করে দেওয়ার জন্য। আসলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই ছিল অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা, যার মাধ্যমে চেষ্টা থাকত দেশের ভেতরের মুক্তিকামী বন্দিপ্রায় অসহায় মানুষগুলোর মানসিক শক্তিকে উজ্জীবিত করা।

অন্যদিকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মনোবল বিপর্যস্ত করে বিপথে চালিত করা এবং মানসিকভাবে হীনবল করে ফেলা। সেই লক্ষ্যে এই কেন্দ্র থেকে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথিকা, জীবন্তিকা, কল্যাণ মিত্র রচিত ও রাজু আহমেদ অভিনীত ‘জল্লাদের দরবার’-এর মতো নাটক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও গুণিজনের সাক্ষাৎকার, কখনো কখনো রাজনৈতিক নেতাদের জ্বালাময়ী ভাষণ, কবিতা পাঠ ইত্যাদি। এর পাশাপাশি ছিল চেনা-অচেনা শিল্পীদের স্বাধীনতার গান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ও দেশাত্মবোধক গান। আরো প্রচারিত হতো এম আর আখতার মুকুলের কণ্ঠে সেই অতি জনপ্রিয় ‘চরমপত্র’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান এবং ‘বজ্রকণ্ঠ’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান, যা ধর্ম-বর্ণ ও দল-মত-নির্বিশেষে সব মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে প্রবল করে তুলত। এখান থেকে এ ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারের আরো একটা লক্ষ্য ছিল সেটা হলো বাইরের পৃথিবীর রাজনৈতিক নেতা এবং সেসব দেশের কোটি কোটি মানুষদের এ দেশে চলমান গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে অবহিত করা।

জুন-জুলাই মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বেড়ে যাওয়ার কারণে জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে হাজার হাজার মানুষ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে জীবন বাঁচাতে ওপারে চলে যায়। পরে তাদের বেশির ভাগের আশ্রয় জুটেছে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে। সে সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অনেক শিল্পী, নাট্যকর্মী, সাংবাদিক, বাদ্যযন্ত্রী, সাংস্কৃতিককর্মী, কবি, সাহিত্যিক, যারা পরে বিভিন্ন সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

এদিকে জুলাইয়ের শেষ দিকে আমার জন্যও গ্রামের বাড়িতে থাকা কঠিন হয়ে পড়ল। যদিও তখন আমার সঙ্গে পেয়ারা বাগান থেকে পালিয়ে আসা শাহনেওয়াজের নেতৃত্বাধীন সর্বহারাদের একটা দলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তাদের ভয়ে তখন সদ্য গঠিত স্থানীয় রাজাকার বাহিনী সাধারণ মানুষদের ওপর বিশেষ করে রাতের বেলায় খুব বেশি অত্যাচার চালাতে পারত না। কিন্তু দিনের বেলা এখানে-সেখানে যে নানা ধরনের কুকর্ম করে বেড়াত, সে খবর পেতাম। তবে আমার ধারে কাছে তারা বেশি আসত না। কিন্তু ওদের কোনোভাবে বিশ্বাস করা যেত না। তা ছাড়া ওপরমহল থেকে আমাকে ধরে নেওয়ার জন্য নির্দেশ চলে এসেছিল জেলা পিস কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে। সে খবরটাও পেয়ে গিয়েছিলাম শাহনেওয়াজের মাধ্যমে।

একাত্তরের মার্চের ১৯ তারিখে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘অবিনাশী ধ্রুবতারা’ নামে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্র থেকে আমার লেখা একটি গল্প প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে আমার বরিশালের ঠিকানা ছিল। গল্পটি প্রচারের দিন-সাতেক আগে রেকর্ড করে বরিশালে চলে এসেছিলাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না, বরিশাল থেকে আমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে এখানে খবর দেওয়া হয়েছে। তখন কোনো ধরনের ঝুঁকি নিলাম না। যদিও সে বছর জুলাই থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রচন্ড রকম ঝড়-বৃষ্টি। মাঠঘাট-জলকাদায় একাকার। সেই ঝড়-বাদলের মধ্যেই যোগাযোগ করে মঠবাড়িয়া গিয়ে রিয়াজউদ্দিনের নৌকার বহরে করে বাবা-মা-ভাই- বোনসহ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পাঁচ দিন পরে পৌঁছে গেলাম ওপার বাংলার সুন্দরবনসংলগ্ন মাতলা নদীর পাড়ে জেলেপল্লী ঝড়খালীতে। ঝড়খালী তখন ছিল অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন দুর্গম এক চরাঞ্চল। বেশ কয়েকঘর জেলেদের বসবাস। সেখানে ছিলাম দুদিন। পরে একটা গয়না নৌকায় করে সুন্দরবনসংলগ্ন গোসাবা বাসন্তী ছাড়িয়ে নামলাম এসে ক্যানিং। সেখান থেকে ট্রেনে নৈহাটি, আমার বোনের বাড়িতে।

দু-তিন দিন শুয়ে বসে কাটালাম। আসলে ঘোর কাটছিল না। সবকিছুই একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। সপ্তাহখানেক পরে শিয়ালদহর কাছে শ্রীনিকেতন হোটেলে গেলে দু-তিনজন নেতার সঙ্গে দেখা হলো। তাদের একজনের কাছ থেকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঠিকানাটা পেয়ে গেলাম। দুদিন পরে এক দিন সকালের দিকে চলে গেলাম বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে।

বড় রাস্তার পাশে ট্রাম থেকে নেমে কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের উল্টোদিকের রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা হেঁটে আসার পরে ডানপাশে চোখে পড়ল গাছপালায় ঘেরা বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের বাড়ি। সে বাড়ি ছাড়িয়ে আরো কিছুটা সামনে গিয়েই পেয়ে গেলাম সেই দোতলা বাড়িটা। তার উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে একটা অতি সাধারণ চায়ের দোকান। তার সামনে দেখলাম চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে পুরোনো দিনের সাংবাদিক বন্ধু আমিনুল হক বাদশা, আশরাফুল আলম আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সুব্রত বড়ুয়া। দেখা হওয়ার পর বেশ কিছুটা সময় কাটানো হলো ওদের সঙ্গে। খবরা-খবর নেওয়া হলো। সবার অবস্থায়ই প্রায় একই ধরনের। উদ্বাস্তু হয়েই এ দেশে এসেছে সবাই। অনেকের পরিবারের কেউ কেউ এখনো রয়ে গেছে দেশে। আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবের কোনো খোঁজখবরই পাওয়া যাচ্ছে না। যে যেখানে যেমনভাবে পারছে, থাকছে। কোনো কিছুতে কোনো বাছবিচার নেই। এ এক অদ্ভুত জীবনযাপন চলছে সবার। অনেকটা মানবেতর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার মতো।

কিছু সময় পর ওরাই আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখি অতি সাধারণভাবে কাজকর্ম চলছে। টেবিল-চেয়ারের সংখ্যা কম ও একটা রুমের ভেতরে ভারী পর্দা টানিয়ে অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের কাজ চলছে ওপরে। একপাশে দেখলাম গানের রিহার্সাল চলছে। সেখানে হারমোনিয়াম ছাড়া তেমন কোনো বাদ্যযন্ত্র দেখলাম না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চেনা পেয়ে গেলাম অনেককে। পেলাম সে সময়ের বিখ্যাত গিটারিস্ট সমর দাস, অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, শহিদুল ইসলাম, অনু ইসলাম, টি এইচ সিকদারসহ আরো অনেককে। সবাই কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত।

ঘণ্টাখানেক পর দেখা হলো আমার অসীম শ্রদ্ধার মানুষ আলমগীর কবির ভাইয়ে সঙ্গে। আমাকে দেখে তো অবাক। বসিয়ে আমাদের সবার খবরাখবর নেওয়ার পরে বললেন, বাংলা কবিতা আর কথিকা লেখ, ঠিক আছে। তবে এখন থেকে এখানকার জন্য কিছু ইংরেজিতে লিখতে হবে। আমার সঙ্গে সময় দিতে হবে। পারবে?

বললাম, অবশ্যই পারব। সেই থেকে শুরু আমার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নতুন জীবন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close