আনোয়ারুল হক

  ২৬ মার্চ, ২০২১

ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ

‘বাংলাদেশ’ নামে ভাষাভিত্তিক একটি নতুন দেশের জন্ম হলো যাদের মুখের ভাষা বাংলা, আর তার পেছনে শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এ আহ্বান, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

প্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০), অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় যে বেদনার কথা ব্যক্ত করেছেন, তাতে চারশত বছর আগেও বাংলা ভাষার অবস্থা, অবস্থান কেমন ছিল তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যতটুকু এগিয়েছি তার পরিমিত আলেচনায় যাওয়ার আগে কবিতাটি উদ্ধৃত করছি,

‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।/দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়?/মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি/দেশি ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।’

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উটপাখি’ কবিতা থেকেও কয়েকটি চরণ তুলে ধরি

‘আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?

কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে/কোথায় লুকোবে? ধু-ধু করে মরুভূমি

ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।/আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই

নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ/কোথায় পালাবে? ছুটবে বা আর কত?...

যে প্রশ্ন এখানে উচ্চারিত হয়েছে তাকে সতর্কবাণী বলাই বাঞ্ছনীয়। চক্ষুষ্মান, বিবেকবান মানুষের পক্ষ থেকেও আছে সরল জিজ্ঞাসা। শূন্যতায় আশ্বাস ও বিশ্বাসের চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে, আমাদের ভূখন্ডের চারদিকে উন্নয়নের দৃশ্যমান জোয়ারে ভাসতে ভাসতে, আমরা যে আসলেই হয়ে গেছি অত্যাসন্ন অদৃশ্য ঝড়কে ভুলে থাকতে চাওয়া সময়ের বাক্সবন্দি মানুষ! যে মানুষের আবেগ আছে কিন্তু কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই! স্বধীনতার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে মনে হয়, কেবলই কি শূন্যতায় ভাসছি না আমরা? আত্মনির্ভরশীল সচেতন জাতি হতে আর কত দিন, কত দীর্ঘ বছর, আরো কতগুলো বছর পার হতে হবে আমাদের?

ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের অভাব নেই সংসারে। সে কারণে, কোনো কোনো মানুষের চোখ থাকে আলোর দিকে, সব সময় সে বসবাস করে মঙ্গল এবং কল্যাণের নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, সত্য ও সুন্দরের দিকে নিয়ে যেতে চায় আগামী দিনের যৌবন ও প্রাণশক্তিকে, মনে করি, তারা সংবেদনশীল মানুষ। প্রতিনিয়ত তাদের বিশ্বাসের ভেতরে জন্ম নেওয়া শুভ চিন্তার প্রতিফলন আরো কিছু মানুষকে জাগিয়ে রাখে। ভাবনার খোরাক জোগায়। কেননা, তারা জানে, কে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে, সেটা বড় কথা নয়। কে কোথায় জেগে আছে সেটাই বড় কথা।

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ থেকে আমরা জানি, মা মানে মাতৃভাষা তখন খুব সুখে ছিল না। আর্য ভাষা সংস্কৃতির বাধার মুখে তাকে গোপনে গোপনে পথ চলতে হয়েছে। তবু হাজার বছরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে বাঙালি। মধ্যযুগের বড়ু চন্ডীদাস, বিপ্রদাস পিপিলাই, কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর পার হয়ে আমরা এলাম আধুনিক যুগে। যাকে বলা হয় যুগসন্ধিক্ষণের কবি, ঈশ্বরগুপ্তের (১৮১২-১৮৫৯) কবিতার বিষয় বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানিয়েছে বাঙালি। কিন্তু আমাদের মন এবং মনন রইল অতৃপ্ত। জন্ম নিল সময়ের সন্তান। আমাদের ঠাঁই হলো আচার-প্রথা-সংস্কার ভাঙার প্রথম বিদ্রোহী কবি মাইকেল মদুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) বিপুল বৈভবের বারান্দায়। যশোরের কপোতাক্ষ নদের তীরে মধু কবির হাতে দুঃখী বর্ণমালা গতি পেল মহাকাব্যের মহাসাগরের ঢেউয়ের ব্যঞ্জনায়। তার কাব্যে যে আত্মসচেতন ব্যক্তি, স্বাধীন বাঙালির দেখা আমরা পেলাম, সেই বাঙালির বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পরের পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বিশ্বজয় করল (১৯১৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ভাষা ও ছন্দের বর্ণের গীতিময়তায়।

তারপর সমকালে অনুজ কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) কাব্য-সাহিত্যে দৃঢ়তার সঙ্গে নিয়ে এলেন বাঙালির আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস। এই যে বাঙালির পরিচয় নিয়ে আসা হলো, এ বাঙালি কখনো দ্বিধাবিভক্ত ছিল না। ধর্ম আলাদা ছিল বটে কিন্তু একত্রে বসবাসে তারা কখনো আলাদা ছিল না। সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যে তারা একসঙ্গেই তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন করেছে। ঠোকাঠুকি লাগেনি। লাগলেও মুখ দেখাদেখি ছিল, কেউ কাউকে পিঠ দেখায়নি। বিগত দুশো বছরের (১৭৫৭-১৯৪৭) রাজত্বে ইংরেজদের অবদান আছে সাহিত্যে বিজ্ঞানে দর্শনে প্রযুক্তিতে আধুনিকতায় নবজাগরণে। অবশ্যই আছে। কিন্তু শাসন এবং শোষণের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি তারা যেটা করেছে আমাদের, তা হলো ‘ভাগ কর, এবং শাসন কর’ এ নীতির রাজনীতি করে। তাদের বিভেদের রাজনীতি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালিকে সেদিন জানিয়ে দিল তোমরা আলাদা। এক নও। ভাষা এক হলে কী হবে? তুমি হিন্দু, তুমি মুসলমান। ধর্মে এক নও, দুই জাতি।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে নিহত কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) লাহোরে এক অধিবেশনে কাজের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান (১৮৯৬-১৯৫১) বিরোধিতা করায় নাকচ হয়ে যায়। সরকার প্রধানদ্বয়ের এ রাজনৈতিক বিরোধিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উত্তেজিত করে তোলে। আন্দোলনকে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দলের ছাত্ররা মিলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গঠন করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সংগ্রাম পরিষদ পালন করে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’।

এ ছাড়া এ অংশের বাঙালিরা আরো দেখল, ডাকটিকিট, মুদ্রা ও মানি অর্ডার ফরমে উর্দুসহ সরকারি কাজকর্মে ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার ছাড়া বাংলা ভাষার কোনো স্থান সেখানে নেই। এসব কারণ ছাত্রসহ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে তোলে। গণ-আন্দোলন দমিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে একসময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী উর্দুভাষী খাজা নাজিমউদ্দীন (১৮৯৪-১৯৬৪) ‘সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহৃত হবে, শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা’ ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন। এ কথাও বলেছিলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষার দাবি তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে তুলে ধরবেন। কিন্তু এসব কিছুই না করে উল্টো ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানে সফরে এসে এক জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ‘প্রাদেশিক ভাষা কী হবে তা ঠিক করবেন প্রদেশের লোকরা। কিন্তু দেশের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’

এ ঘোষণার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয় এবং সর্বদলীয় কমিটির সিদ্ধান্তে ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল এবং বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। হরতাল, বিক্ষোভ দমনের পন্থা হিসেবে সেদিন সরকারের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমিতি, মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়। এর পরের ফলাফল আমাদের সবারই জানা। নিষেধ উপেক্ষা করার ফলে পুলিশ গুলি চালালে বরকত, রফিক, জব্বার ও সালাম প্রমুখ শহীদ হন। পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি গুলি চালানোর প্রতিবাদে যে মিছিল বের হয় সেদিনও পুলিশ গুলি চালালে শফিউর রহমানসহ কয়েকজন নিহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৯৫২ সালে একুশের মিছিলে পুলিশের গুলি ও রক্তপাতের ফলে সারা দেশে এরপর ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলন এতই দানা বাঁধে যে, এর গভীর প্রভাব পড়ে রাজনীতিতে এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে। যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল সেই দলটি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের যেখানে গুলি চালানো হয়েছিল সেখানে নির্মিত হয় ‘শহীদ মিনার’ যেটি সেদিন থেকেই বাঙালিদের কাছে তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে এবং সবস্তরে তৈরি হয় ভাষার প্রতি মমত্ববোধ এবং উন্মেষ ঘটে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনার। বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবর্তিত পরিবেশে পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীক রূপে তখন থেকে বিবেচিত হতে থাকলেন।

এ সময় পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির শত্রু বলে চিহ্নিত করল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালনে রাষ্ট্রশক্তি বাধা দিয়েছিল যদিও সেই বাধা অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ে বেতার-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বিশ্বকবির পক্ষে ব্যাপক জনমতের ফলে পরের বছর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে আবার ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কোনো কোনো কবিতার ভাষা ও শব্দচয়নে ‘হিন্দুয়ানী’ বলে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন আজ স্বাধীন বাংলাদেশে রণসংগীত বলে পরিচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটির ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ পঙ্ক্তির ‘মহাশ্মশান’ শব্দটি পাল্টিয়ে ‘গোরস্তান’ করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল।

বস্তুত, এসব করে ১৯৬৭ সালে বাঙালিয়ানার স্রোত ঠেকাতে গিয়ে ফল হয়ে গেল উল্টো। বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা প্রবল হলো আরো। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করল, রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে বরণ করে নিল, তাদের অভেদ জাতীয় জাগরণ শুরু হলো এ সময়ে। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ছয় দফা ঘোষণা করে (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন পুরো জাতিকে। রক্ত দিতে দিতে ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ এ বাঙালির শুরু হলো স্বাধীনতাযুদ্ধ। ‘বাংলাদেশ’ নামে ভাষাভিত্তিক একটি নতুন দেশের জন্ম হলো যাদের মুখের ভাষা হলো বাংলা, আর তার পেছনে শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এ আহ্বান,

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

কিন্তু দুঃখিনী বর্ণমালা বাংলা ভাষার দুঃখ দেশ স্বাধীন হয়েও ঘুচল না।

১৭৫৭ সালের মীরজাফরের রক্ত আবার আঘাত হানল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে, নিজভূমে, সেই রাতে বঙ্গবন্ধু যাদের মনে করতেন স্বজন, তাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন। ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, বিশাল হৃদয়ের একটি মানুষ, গণমানুষের নেতা, শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরা থেকে বিদায় করে দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রটিকে আবার খামচে ধরল পুরোনো সেই শকুন। যেখানে শুধু লাশের গন্ধ ছাড়া আর কোনো সুবাতাস ছিল না। নৃশংস, মর্মান্তিক, গভীর দুঃখের এ হত্যাযজ্ঞের ফলাফলের দিকে যাওয়ার আগে আর একটি প্রসঙ্গের দিকে আলো ফেলতে চাই, যার সঙ্গে এ বিষয়ের সাযুজ্য আছে।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বাদ দিয়ে ‘বাঙালি’ শব্দের একচেটিয়া মালিক হয়ে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা। ইতিহাস বলে, উনিশশতক থেকেই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিরা নিজেদের বাঙালি বলে দাবি করে এসেছেন এবং তারা মুসলমানদের বাঙালি বলে গণ্যই করেনি। মুসলমানরাও নিজেদের বাঙালিত্বের পরিচয় নিয়ে কখনো দাবি তোলেনি। ১৯৪৭ সালের পর পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা সমগ্র বাংলা ভাষীকে (পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙালি বলে মেনে না নেওয়ার মনোভাব বজায় রাখল। কিন্তু নিজেরা মাতৃভাষা বাংলা সত্ত্বেও বাঙালিয়ানা থেকে সরে গিয়ে ভারতীয় হয়ে গেলেন। তাদের রাষ্ট্রভাষা হলো হিন্দি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি। পশ্চিবঙ্গের উন্নাসিক বাঙালিরা যে মুসলমান বাঙালিদের বাঙালি মনে করে না ইতিহাসের বিস্ময় এক অবিস্মরণীয় ঘটনার জন্ম দিল তারাই। ১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথে মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়ে তারা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিল, বাঙালি বলতে হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, যাদের মুখের ভাষা বাংলা সে হিন্দু, মুসলমান কিংবা বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যে-ই হোক না কেন, সে বাঙালি। বলা বাহুল্য, বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতার এ চেতনাকে হত্যা করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে হত্যার মধ্য দিয়ে।

আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশে অপরাজনীতির অনাকাক্সিক্ষত কুফল মাতৃভাষা বাংলাকে বহন করতে হচ্ছে মনে করি, তার প্রমাণ দেওয়ার অপেক্ষা লাগে না। সবস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার নির্দেশ সরকারিভাবে জারি থাকলেও আমরা নিজেদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, ভালোবাসা না থাকলে, কূপম-ূকতা আমাকে ঘিরে থাকলে, পুরোনো শকুন আমাদের চোখ-মুখ খামচে ধরে থাকলে সরকারি নির্দেশে কোনো কাজ হয় না। রক্ত দিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, এক সাগর রক্ত দিয়ে, ত্রিশ লাখ শহীদ আর মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে, নতুন একটি দেশ হয়েছে, ভৌগোলিক পরিবর্তন হয়েছে, বাঙালি শাসক পেয়েছি আমরা, সংবিধানে রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা, প্রতিটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা অথচ আজও আমার দুঃখিনী বর্ণমালা আজও নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

জানেন সবাই, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নয়। যা হওয়ার কথা ছিল। আমরা বিদেশে লেখাপড়া করতে গেলে যে দেশেই যাওয়া হোক না কেন, সেই দেশের ভাষা আগে রপ্ত করতে হয়। তাহলে আমাদের নয় কেন? এ প্রশ্ন আমি করতে পারি, আবার এও জানি এর উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ বসে নেই। নিশ্চিত মনে করি, অনান্তরিক বলে, যার যা দায়িত্ব, যে প্রতিষ্ঠানের যা করার কথা সেটা সময়মতো পালন করেনি বলেই আজ আমাদের এই বিড়ম্বনা। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ভাষার প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা একাডেমি’র উচিত ছিল সর্বাগ্রে বিদেশি ভাষার পরিভাষা তৈরি করা। সাহিত্য, দর্শন, সমাজ-বিজ্ঞানসহ বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে তামাম প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অনুবাদ প্রকাশ করা এবং বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় বিদেশি গ্রন্থের জোগান দেওয়া। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছি, বাংলা একাডেমি সে দায়িত্বটি ঠিকমতো পালন করছে না। সারা দেশে শিক্ষাদান পদ্ধতি ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়েছে। এফএম রেডিও, বেসরকারি চ্যানেল, টেলিভিশনসহ সব ক্ষেত্রে বিকৃত বাংলা ভাষার ব্যবহার দৃষ্টি-শ্রুতিকটুভাবে বেড়েছে।

ফলে, আমাদের বাংলা ভাষার দুর্দিন ‘করোনাভাইরাস’-এ পরিণত হওয়ার আগে প্রতিটি শিক্ষিত সচেতন বাংলা ভাষাভাষীর মনোযোগ আকর্ষণ করা হচ্ছে। যদি ইংরেজি লিখতে গিয়ে বানান, শব্দ, বাক্য গঠন ভুল না হয়, তাহলে আমার মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রেও যেন তা হয়। চাই সবস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার। না হলে, যাদের আত্মত্যাগে আজ আমরা বিশ্বের দরবারে আলাদা জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি, তাদের অপমান হয়। ভাষার মূল্যকে যদি আমরা মূল্য না দিই তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি বলে বিবেচিত হব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close