হাসান মাহমুদ বজ্রের হাঁসির গল্প
নন্দলালের দর্শনচর্চা
নন্দলাল ছিলেন এক সদা-ব্যস্ত কিন্তু অস্থিরমনা মানুষ। তার জীবনের মূল সংকট ছিল, কিছুতেই তিনি সুখী হতে পারতেন না। গ্রামের সবাই বলত, ‘নন্দলাল, তুমি এত চিন্তিত কেন?’ কিন্তু নন্দলাল উত্তর দিতেন, ‘জীবনের অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।’ এ কথা শুনে গ্রামের মানুষ মুচকি হাসত, কিন্তু নন্দলাল ছিলেন অবিচল।
একদিন তিনি স্থির করলেন, সত্যিকারের জ্ঞানী কারো কাছ থেকে জীবন সম্পর্কে দীক্ষা নেবেন। তিনি গেলেন গুরু শঙ্করানন্দের কাছে। গুরু গম্ভীরমুখে বললেন, ‘যাও, নদীর ধারে একটি কাক দেখবে। তার থেকে জীবন ও সুখের শিক্ষা নাও।’
নন্দলাল গুরুদেবকে প্রণাম করে বললেন, ‘কাকের থেকে শিক্ষা? গুরুদেব, কাক তো সারাদিন কা-কা করে এবং উচ্ছিষ্ট খায়!’
গুরুদেব ধীর কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক তাই। আর সেখানেই তোমার জীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে।’
নন্দলাল নদীর ধারে বসলেন। এক কাক মাটির উপর থেকে কিছু খাবার তুলে নিয়ে পাশের কুকুরের সামনে রেখে গেল। নন্দলাল ভাবলেন, ‘কাক এত উদার হতে পারে? আমি কী শিখব!’
কাকের পাশে বসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে কাক, তুমি এমন উদার কেন?’
কাকটি কা-কা করে উড়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটি বৃদ্ধ লোক এলেন। তিনি বললেন, ‘এই কাকটি প্রতিদিন এখানে এসে খাবার রেখে যায়। ও জানে, সুখ হলো যা দাও, তা-ই ফেরত আসে।’
নন্দলাল কাকের দানশীলতা থেকে শিক্ষা নিয়ে শুরু করলেন নিজের খাবার ভাগ করা। কিন্তু গ্রামের লোকেরা তার বাড়ি আসতে শুরু করল। একদিন এত মানুষ এসে খেয়ে গেল যে, বাড়িতে কিছুই রইল না। তিনি আবার গুরুদেবের কাছে গিয়ে বললেন, ‘গুরুদেব, কাকের শিক্ষা নিয়ে আমি সর্বস্ব হারিয়েছি!’
গুরুদেব হেসে বললেন, ‘কাক কখনো নিজের প্রয়োজনের বেশি দান করে না। তুমিই অতি-শিক্ষিত হলে।’
নন্দলাল এবার নিজ জীবনের জন্য একটি নিয়ম তৈরি করলেন। প্রয়োজন মেটানোর পর যা থাকে, তাই ভাগ করবেন। ধীরে ধীরে তিনি খুঁজে পেলেন শান্তি, আর গ্রামের মানুষ তাকে ডাকতে শুরু করল ‘দর্শনচর্চার গুরু’ বলে।
এইভাবে নন্দলাল বুঝতে পারলেন, গুরুগম্ভীর দর্শন চর্চার আসল মজাটি হল জীবনের হাস্যরস উপভোগ করায়।
গুরু শঙ্করানন্দের শিক্ষা নিয়ে নন্দলাল নিজেকে দার্শনিক বলে ঘোষণা করলেন। এখন তিনি সকালে কাক দেখেন, দুপুরে ছাগল, আর রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তা করেন। তিনি গ্রামের চায়ের দোকানে বসে বলেন, ‘দেখো ভাই, জীবনের মূল সমস্যা হলো- আমরা কাকের মতো বাঁচতে পারি না!’
চায়ের দোকানদার গোবিন্দ বলল, ‘তা হলে তো কা-কা করতে করতে পাগল হয়ে যেতেন!’
সবার হাসি থামার পর নন্দলাল বললেন, ‘তোমরা বোঝো না! কাকের মতো জীবন মানে- বিনা দামে খাবার পাওয়া আর পৃথিবীর ময়লা পরিস্কার করা।’
নন্দলাল এবার নতুন দর্শন বের করলেন- ‘বৃক্ষবাদ’। তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘গাছেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। গাছেরা কোনো দুঃখ অনুভব করে না। আমরা যদি গাছের মতো চুপচাপ থাকতাম, জীবন হত শান্তিময়।’
এবার তিনি চুপ থাকার ব্রত নিলেন। বাড়ির উঠোনে একটি তালের গাছের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। গ্রামবাসী এ দৃশ্য দেখে পেট ভরে হাসল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল যখন একটি ছাগল এসে তার ধুতিতে দাঁত বসাল। নন্দলাল মুখ না খুলে ছাগলকে পা দিয়ে ধাক্কা দিলেন। ছাগলটি খেপে গিয়ে তার শিং দিয়ে নন্দলালকে এমন এক ঘা দিল যে তিনি বেসামাল হয়ে পড়লেন।
‘গাছের মতো থাকলে ছাগল কামড়ায়, আর মানুষ ভাবে আমি পাগল!’ আহত অবস্থায় চিৎকার করে বললেন নন্দলাল।
নন্দলাল এবার সিদ্ধান্ত নিলেন, একা দর্শনের পথে হাঁটা বিপজ্জনক। তাই তিনি “বিশুদ্ধ দর্শনের ক্লাব” খুললেন। ক্লাবের নিয়ম ছিল- একবার ঢুকলে কেউ কথা বলতে পারবে না। শুধু চোখের ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান করতে হবে।
ক্লাবের প্রথম বৈঠকে পাঁচজন এল। নন্দলাল প্রথমেই কাগজে লিখলেন,
‘কেউ কথা বলবে না।’
সবাই মাথা নেড়ে রাজি হল।
পনেরো মিনিট চুপচাপ থাকার পর এক সদস্য হাত নাড়াল।
নন্দলাল ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী সমস্যা?’
সে কাগজে লিখল, ‘গলা শুকিয়ে গেছে। একটু জল চাই।’
দুই মিনিট পরে আরেকজন লিখল, ‘পেটে ব্যথা করছে। আমি কি বের হতে পারি?’
বৈঠকের শেষদিকে, আরেকজন রাগে কাগজ ছুঁড়ে ফেলে বলল, ‘এই ক্লাবটাই তো বাজে কথা! সব দর্শন যদি লিখতে হয়, তবে চায়ের দোকানে চুপচাপ বসলেই তো হত!’
ক্লাব ভেঙে গেল। নন্দলাল বুঝলেন, দর্শন শেখানো কঠিন কাজ। তিনি আবার গুরুদেবের কাছে গেলেন এবং গুরু বললেন, ‘দর্শনের চেয়ে ভালো জীবন হলো- চুপ করে নিজের কাজ করা।’
নন্দলাল এবার আর গুরুগম্ভীর ভাব দেখালেন না। তিনি চায়ের দোকানে বসে বললেন, ‘আরে, জীবন হলো কাক আর ছাগলের মিশ্রণ! কখনো কা-কা করো, কখনো লাফাও।’
গ্রামের সবাই এবার সত্যিই তাকে মান্য করল। আর নন্দলাল জীবনের হাসি আর মজাকে নতুনভাবে উপভোগ করতে লাগলেন।
"