হানিফ ওয়াহিদের হাসির গল্প
মর্জিনা
আমার বাসায় বিচার বসেছে। একমাত্র ভয়ংকর অপরাধী আমি। আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য ভালো, এখনো পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয় নাই। বিচারক আমার বউ, সহযোগী বিচারক আমাদের পাশের বাসার শায়লা ভাবি। ফরিয়াদি আমার বাসার কাজের মেয়ে মর্জিনা। মর্জিনার সহযোগী আবার শায়লা ভাবিদের কাজের মেয়ে নুরজাহান।
আমার অপরাধ, আমি নাকি আমাদের বাসার কাজের মেয়ে মর্জিনাকে অপমান করেছি। মর্জিনা এই কথাটা বলেছে নুরজাহানকে। নুরজাহান রং চড়িয়ে সেটা বলেছে শায়লা ভাবিকে। শায়লা ভাবি আরেকটু রং চড়িয়ে বলেছে আমার বউকে। আর বউ?
থাক, আর না বলি। ঘরের খবর পরের জেনে লাভ কী?
ঘরের অবস্থা বেশ থমথমে। মর্জিনা আলটিমেট ঘোষণা করেছে, সুষ্ঠু বিচার না পেলে এ বাড়িতে আর কাজ করবে না। তার কাজের অভাব নাই। কত লোকজন এসে তার পায়ে ধরতেছে কাজ করার জন্য! তার সাথে যোগ দিয়েছে নুরজাহান। এই বিচার না হলে সেও কাজ ছেড়ে দিবে। গরীব বইলা কি তাগো বিচার পাওয়ার অধিকার নাই?
আমি বললাম, মর্জিনা আমি তোমাকে কখন অপমান করলাম? তাছাড়া তোমাকে অপমান করলে নুরজাহান কাজ ছাড়বে কেন? প্রেমিক প্রেমিকাও তো একজন আরেকজনের জন্য এত দরদ দেখায় না, যেটা নুরজাহান তোমার জন্য দেখাইতেছে!
মর্জিনা লাফিয়ে উঠে বলল, এই তো আবার অপমান করলেন! আপনের তো কতায় কতায় অপমান করা স্বভাব। আমরা গরীব বইলা কি মানইজ্জত নাই? আমরা কি ভাইসা আসছি?
তো তোমারে কখন অপমান করলাম?
মর্জিনা কথা বলার আগেই বউ আমাকে বলল, এই তুমি একটা কথাও বলবা না। মর্জিনা তুমি ঘটনা খুলে বল।
ম্যাডাম, আপনের জামাইয়ের কতায় কতায় রাগারাগি করার স্বভাব। সেদিন দেখলাম, রাস্তার পাশের দোকানদারের লগে রাগারাগি করতাছে...
মর্জিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই শায়লা ভাবি বললেন, ব্যাটা মানুষ আর কিছু পারুক আর না পারুক বউয়ের সাথে রাগারাগি ঠিকই পারে। পুরুষ মানুষের খাসলত বহুত খারাপ...
শায়লা ভাবির কাজের মেয়ে নুরজাহান সমর্থন করে বলল, একদম খাঁটি কতা কইছেন ভাবি, পুরুষগো খাসলত আমার জানা আছে। এরা বদের বদ!
আমি বললাম, আরে ভাবী, সে বলতেছে দোকানদারের কথা, আপনি আবার কী ঝামেলা করেন? দোকানদার আমাকে পঁচা ডিম গছিয়ে দিয়েছে বলে রাগারাগি করেছি। মর্জিনা, তোমার সাথে কখন রাগারাগি করলাম?
মর্জিনা মাথা চুলকিয়ে বলল, আচ্ছা এই ঘটনা বাদ, আপনে তো সখিনার লগেও রাগারাগি করতেন...
সখিনা আমাদের বাসায় আগে কাজ করত। তার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মর্জিনাকে আনতে হয়েছে। দুই মাস আগে সখিনাই ওকে ঠিক করে দিয়ে গেছে।
আমি অসহায় গলায় বললাম, সখিনা তোমাকে বলেছে এই কথা?
আমারে বলতে হইব কেন? আমি কি জানি না? আমি কি আন্ধা? আমার চোখ কি বিলাই খাইছে?
তুমি কীভাবে জানো? তুমি তো তখন এই বাড়িতে ছিলে না। বানিয়ে কথা বলছো কেন?
মর্জিনা বলল, আইচ্ছা এই ঘটনাও বাদ।
তুমি তো সব ঘটনাই বাদ দিয়ে দিতেছো, তাহলে বিচার বসাইছো কেন? আমারে তো ফাঁসির আসামী বানাইয়া দিলা...
বউ রাগি গলায় আমাকে বলল, তোমাকে কথা বলতে নিষেধ করলাম না? তুমি এত কথা বলতেছো কেন? মর্জিনা তুমি আসল কথা বল। এই মিচকে শয়তান কী করছে?
ভাবি আপনের জামাইয়ের তো চোখ খারাপ, খালি মাইয়াগো দিকে তাকায় থাকে। কাল দুপুরে আমি দেখছি...
বউ সোফা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বলল, বল কী! এইটা তো আমি জানতাম না, কী করছিল? তোমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকাইছিল,,,,
না, অন্য মেয়ে,,
বউ আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, এই তোমাকে তো আমি ভালো মানুষ বলেই জানতাম, তলে তলে তুমি এই কর... ও আল্লাহ গো, আমার কী হবে গোা... এই সত্যি কথা বল, মেয়েটা কে? বলেই কাঁদতে বসে গেল।
আমি মনে মনে আতংকে ভুগতে লাগলাম, বউ না আবার কান্না থামিয়ে আমাকে এক্ষুণি ছুরি নিয়ে তাড়া করে। আগে দৌড়ে পারলেও এই ভুঁড়ি নিয়ে এখন আর দৌড় দেওয়া সম্ভব না।
শায়লা ভাবি উঠে দাঁড়িয়ে বউকে স্বান্তনার সুরে বলল, দেখছেন ভাবি, আমি বলি নাই, পুরুষ মানুষের খাসলত খারাপ? এখন আমার কথা বিশ্বাস হল? সাপকেও বিশ্বাস করা যায়, পুরুষ মানুষ? কাভি নেহি...
নুরজাহান তাল মিলিয়ে বলল, একদম খাঁটি কতা। বেডা মানুষ আর শয়তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই।
আমি অসহায় হয়ে সোফা হতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, মর্জিনা, আমি তো গতকাল সারাদিন বাসা থেকেই বের হই নাই। দুপুরে একটা দক্ষিণী মুভি দেখেছি। আমি আবার কোন মেয়ের দিকে তাকাইলাম?
মর্জিনা ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, কেন, আপনে সেই টিভির নায়িকার দিকে তাকাইয়া থাকেন নাই? আল্লাহ গো আল্লাহ কী মিথ্যা কতা কয়। আমরা মইরা গেলেও মিথ্যা কতা কই না!
আমি ধপাস করে আবার সোফায় বসে পড়লাম। শায়লা ভাবি মোবাইল টিপাটিপি করতে লাগলেন। নুরজাহান অন্যদিকে তাকিয়ে গাল চুলকাতে লাগল। বউ মনে হয় আমাকে তলে তলে খুন করার পরিকল্পনা করছিল, আপাতত সেই চিন্তা বাদ দিয়ে মর্জিনাকে ধমক দিয়ে বলল, আসল কথা বল, তোমাকে কখন অপমান করা হয়েছে?
ভাবি সুষ্ঠু বিচার করবেন তো?
অবশ্যই করব। তুমি বলো কী হয়েছে।
গত পরশু আমার হাত থিকা পইড়া দুইটা গ্লাস ভাঙ্গছে না...
বউ মর্জিনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, গত পরশু তুমি গ্লাস ভেঙ্গেছো? কই, আমি তো জানি না...
আমি বললাম, তোমার এক বিদেশি বান্ধবী এক ডজন বেলজিয়াম গ্লাস পাঠিয়েছে না? ওখান থেকে মর্জিনা পরশু দুইটা গ্লাস ভাঙ্গছে। আমি জানি, আমি মারা গেলেও এতটা কষ্ট পাবে না, যতটা কষ্ট পাবে তোমার প্রিয় গ্লাসের জন্য। সেজন্যই তোমারে বলি নাই।
বউ হায় হায় করে উঠল। এতক্ষণ বউ কাঁদছিল স্বামীর চরিত্রের শোকে, এখন কাঁদছে গ্লাসের শোকে। ভেঙ্গে যেতে পারে বলে বেচারি নিজে কখনো এই গ্লাস দিয়ে পানি খায় না। মর্জিনা মোছামুছির সময় সেখান থেকে দুইটা ভেঙেছে।
শায়লা ভাবি এবার বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে বসলেন, মর্জিনা, হানিফ ওয়াহিদ ভাই তোমাকে কীভাবে অপমান করছে সেইটা ভাবিকে খুলে বল... ডিটেইলস বলবা, কোনোকিছু বাদ দিবা না...
শায়লা ভাবি নরম গলায় বলল, শোনো মর্জিনা, হানিফ ওয়াহিদ ভাই তো তোমাকে গালি দেয় নাই... কীভাবে অপমান করলো?
মর্জিনা লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, গালি দিলে আপনে খুশি হইতেন? জানি তো গরীবের বিচার নাই। আপনেরা সবাই এক। আমি আর এই বাসায় কাজ করতাম না। আজই চইলা যামু। বলেই সে ধুপধাপ করে ঘরের ভিতর ঢুকে গেল।
বউ দৌড়ে গিয়ে মর্জিনার হাত চেপে ধরে বলল, মর্জিনা কর কী? তোমার ভাই না হয় না বুঝে একটা অপরাধ করে ফেলেছে, তাই বলে কী আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে? কাজটা কী ঠিক হবে? তাছাড়া তোমার বেতন তো দেওয়া হয় নাই...
মর্জিনা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল, বেতনের ধার মর্জিনা ধারে না। টেকা দিলে দিবেন না দিলে নাই। এত অপমান নিয়া এই মর্জিনা কাম করে না। আমারে ছাইড়া দেন... এমন কাম রে আমি উষ্ঠা মারি।
আমি এগিয়ে গিয়ে মর্জিনার সামনে দাঁড়ালাম। মিনতি ভরা গলায় বললাম, মর্জিনা, আমার ভুল হইছে। এই ভুল আর করব না। আমারে ক্ষমা করে দাও। আমার অপরাধের জন্য দশবার কান ধরে উঠবস করি?
মর্জিনা নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে হেঁচকি তুলে বলল, আমরা গরীব বইলা কতায় কতায় অপমান করেন, আমরা মানুষ না? আমাগো সম্মান নাই?
বুঝলাম সে কান্নার অভিনয় করছে, কিন্তু অভিনয় ভালো হচ্ছে না। তারচেয়ে আমি কান্নার অভিনয় আরো ভালো পারি। সে যদি শাবনুর হয়, আমি তবে বাপ্পারাজ।
এইবার মর্জিনা হেসে ফেলল, এইসব কী কন ভাইজান? আপনে আমাগো বড় ভাই না? আমি তো জানি,আপনে কত ভালোমানুষ!
মর্জিনার কথা শুনে বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল। মনে হল, অভিনয় কাজ দিয়েছে। মর্জিনার মন গলতে শুরু করেছে!
"