মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেনের হাসির গল্প
টানাটানি
ঢাকার একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে কুদ্দুস। পরিবারের বাকি সদস্য গ্রামে থাকায় প্রায় প্রতি মাসেই তাকে বাড়িতে আসতে হয়। এবার বাসস্ট্যান্ডে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটি বাসের হেলপার তার ব্যাগ নিয়ে নেয়, অন্য বাসের হেলপার তার ফলের ব্যাগটি নিয়ে নেয়। দুজন মিলে খুব টানাটানি। একজন বলে আমার বাসে ভাড়া কম, অন্যজন বলে আমার বাসটি গেইট লক ও আরামদায়ক। বাড়ি আসার পথে কুদ্দুস খুব কমই এমন টানাটানির মধ্যে পড়েছে। দুজনেই নাছোড়বান্দা। দুজনেই যখন অনড় তখন কুদ্দুস মনে মনে একটা বুদ্ধি বের করে। দুজনকে ডেকে বলে তোমাদের একটা পরীক্ষা নিব। যে পরীক্ষায় পাস করতে পারবে আমি তার বাসেই যাব। দুজনেই অবাক! যাত্রী পেতে পরীক্ষা। হেলপারি লাইফের বিশ বছরে এমন আজব ঘটনার সম্মুখীন তারা হয়নি, দুজনেই দুজনের দিকে তাকায়। দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠে পরীক্ষাটা কি শুনি।
পরীক্ষাটা খুবই সোজা, আমি যা বলব তাই বলতে হবে এটাই হলো পরীক্ষা। কুদ্দুসের কথায় দুজনেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। ছাত্রজীবনে পড়ালেখায় ভালো ছিল না বলে আজ তারা হেলপার। প্রথমজন (যে কুদ্দুসের ব্যাগটা নিয়েছিল) বলল, আমি আগে পরীক্ষা দেব।
কুদ্দুস বলে এক সেও বলে এক কুদ্দুস যখন দুই বলে সঙ্গে সঙ্গে সেও বলে দুই। কুদ্দুস যখন বলে, দুইয়ের পরে কত? সে তখন বলে তিন।
কুদ্দুস বলে আমি কি তিন বলেছি আমি বলেছি দুই এর পর কত? জিব্বায় কামড় দেয় হেলপার। এত সোজা পরীক্ষায়ও ফেল করলাম। অবশেষে ওর কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠে বসে কুদ্দুস। দ্বিতীয় হেলপার তো মহাখুশি, ভাগ্যিস প্রথমে আমি পরীক্ষা দেইনি। আমিও নিশ্চিত ফেল করতাম।
একটা সমস্যা থেকে বুদ্ধির জোরে বেঁচে যায় কুদ্দুস। ঘণ্টা দুয়েকের মতো বাসটা যেতে না যেতেই কয়েকটা হোটেলের সামনে থেমে যায়। জানা গেল লাঞ্চ ব্রেকের জন্যই বাসটি এখানে থেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে দুই হোটেল বয় কুদ্দুসের ডান হাত ও বাম হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। আমাদের হোটেলে গরুর মাংসের সঙ্গে ছোট মাছ ফ্রি, আরেকজন বলে আমাদের হোটেলে মাংসের সঙ্গে ডিমের তরকারি একদম ফ্রি। দ্বিতীয়জনকে কুদ্দুস বলে আমি ডিম খাই না। সবিস্ময়ে হোটেলবয় জিজ্ঞেস করে- কেন? আপনি কোনোদিনই ডিম খাননি?
-বাবা-মা বলতো ডিম খেলে পরীক্ষায় আন্ডা (শূন্য) পাবি। তখন থেকে ডিম খাওয়া বন্ধ করেছি। এখন আর খাই না। কথাগুলো বলতে বলতে প্রথম হোটেলবয়ের হোটেলে ঢুকে পড়ে কুদ্দুস। ঢুুকেই বলে, আমাকে আগে ফ্রি ছোট মাছের তরকারি দাও তো। হোটেলবয় মুখে রাজ্যজয়ের হাসি নিয়ে ছোট মাছের তরকারি দেয়, তৃপ্তি সহকারে ভাত খেতে থাকে কুদ্দুস।
যখনই হোটেল বয় গরুর মাংস নিয়ে এলো তখনই কুদ্দুস পকেট থেকে প্রেসক্রিপশন বের করে দিয়ে বলল গরুর মাংস খাওয়া একদম নিষেধ। হোটেলবয় দেখলো, একদম সিল মেরে ডাক্তার কথাটি লিখে রেখেছেন। হোটেলবয় খাসির মাংস নিয়ে আসতে চাইলে কুদ্দুসের ঘোর আপত্তি। তুমি তো বলেছিলে গরুর মাংসের সঙ্গে ছোট মাছের তরকারি ফ্রি। অফার পরিবর্তন করা যাবে না। এ জগতে মানুষের জবানটাই আসল। দশ বছরের মেসিয়ারি জীবনে এমন কাস্টমার সে কখনো দেখে নাই। হোটেলবয়ও তখন উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনি তো তখন বললেন না যে আপনার গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ।
-আমাকে বলার সুযোগ দিলে তো বলব। আমাকে নিয়ে দুজনে দুহাত ধরে এমন টানাটানি শুরু করেছো, আমার কথা বলার চান্সই তো তখন ছিল না।
বাস স্ট্যান্ড থেকে কুদ্দুসের বাড়ি ১ কিলোমিটার দূরত্বের মেঠোপথ। বাস থেকে নেমেই টং দোকানে যখন চায়ের কাপে চুমুক দেবে ঠিক তখনই দুজন বীমা কোম্পানির লোক চায়ের দোকানে থাকায় দুজনেই বীমা করার জন্য খুব পীড়াপীড়ি শুরু করে। একজন বলে আমাদের বোনাস অনেক বেশি। আরেকজন বলে আমাদের বীমার মেয়াদান্তে কোনো ঝামেলা নেই। অনলাইনে প্রিমিয়াম জমা দিতে পারবেন। ইত্যাদি নানা সুবিধার কথা দুজনেই বলে চলে। উপয়ান্তর না দেখে কুদ্দুস দুজনেরই মোবাইল নাম্বার নিয়ে বাড়ি গিয়ে ভেবেচিন্তে জানানোর কথা বলে বাড়ির উদ্দেশ্য পা বাড়ায়।
বাড়ি পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায় কুদ্দুসের। বাড়ি পৌঁছে যখন বিশ্রাম করার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিবে ঠিক তখনই কয়েকজন টিচার এসে উপস্থিত। তার মেয়ে কুলসুম এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে। কুদ্দুসের গ্রামে দুটি হাইস্কুল। তারা বলছে যে আমাদের স্কুলে ভর্তি করলে স্কুল ড্রেস ফ্রি। উনারা যাওয়ার পরপরই অন্য স্কুলের টিচাররা বলে, আমাদের স্কুলে কুলসুমকে ভর্তি করলে স্কুল ড্রেস ও ব্যাগ একদম ফ্রি দেব।
দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে রাতের খাবার খেয়ে কুদ্দুস খুব তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যায়। একটু পরে সে বিভোর ঘুমে নাক ডাকতে শুরু করে। নাক ডাকা তো নয় যেন ঘরের ভেতর স্যালো মেশিন স্টার্ট হয়ে গেছে। কুদ্দুস স্বপ্নে দেখে হেলপার তার হাত ধরে টানছে, হোটেল বয় জামা ধরে টানছে, বীমার লোক দুজন তার টাক মাথায় ঢোল বাজাচ্ছে। শিক্ষকরা তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ফোনের পর ফোন দিচ্ছে। ঘুমের ভিতর এত লোকের টানাটানিতে কুদ্দুস ছটফট করছে।
ঘুম ভেঙে গেলে কুদ্দুস দেখে তার বউ তাকে মেঝে থেকে টেনে বিছানায় তুলছে।
"