সুকুমার রায়ের হাসির গল্প
পেটুক
হরিপদ! ও হরিপদ! হরিপদর আর সাড়াই নেই! সবাই মিলে এত চ্যাঁচাচ্ছে, হরিপদ আর সাড়াই দেয় না। কেন, হরিপদ কালা নাকি? কানে কম শোনে বুঝি? না, কম শুনবে কেন, বেশ দিব্যি পরিষ্কার শুনতে পায়। তবে হরিপদ কি বাড়ি নেই? তা কেন?
হরিপদর মুখ ভরা ক্ষীরের লাড়ু, ফেলতেও পারে না, গিলতেও পারে না। কথা বলবে কী করে? আবার ডাক শুনে ছুটে আসতেও পারে না তাহলে যে ধরা পড়ে যাবে। তাই সে তাড়াতাড়ি লাড়ু গিলছে আর জল খাচ্ছে, আর যতই গিলতে চাচ্ছে ততই গলার মধ্যে লাড়ুগুলো আঠার মতো আটকে যাচ্ছে। বিষম খাবার জোগাড় আর কি!
এটা কিন্তু হরিপদর ভারী বদভ্যাস। এর জন্য কত ধমক, কত শাসন, কত শাস্তি, কত সাজাই যে সে পেয়েছে ও তবু তার আক্কেল হলো না। তবু সে লুকিয়ে চুরিয়ে পেটুকের মতো খাবেই। যেমন হরিপদ, তেমনি তার ছোট ভাইটি। এদিকে পেট রোগা, দুদিন অন্তর অসুখ লেগেই আছে, তবু হ্যাংলামি তার আর যায় না।
যেদিন শাস্তিটা একটু শক্ত রকমের হয় তারপর কয়েক দিন ধরে প্রতিজ্ঞা থাকে, এমন কাজ আর করব না। যখন অসময়ে অখাদ্য খেয়ে, রাতে তার পেট কামড়ায়, তখন কাঁদে আর বলে, আর না, এবারেই শেষ। কিন্তু দুদিন না যেতেই আবার যেই সেই। এই তো কিছুদিন আগে পিসিমার ঘরে দই খেতে গিয়ে তারা জব্দ হয়েছিল, কিন্তু তবু তো লজ্জা নেই!
হরিপদর ছোট ভাই শ্যামাপদ এসে বলল, দাদা, শিগগির এসো। পিসিমা এই মাত্র এক হাঁড়ি দই নিয়ে তার খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলেন। দাদাকে এত ব্যস্ত হয়ে এ খবরটা দেওয়ার অর্থ এই যে, পিসিমার ঘরে যে শিকল দেওয়া থাকে, শ্যামাপদ সেটা হাতে নাগাল পায় না, তাই দাদার সাহায্য দরকার হয়।
দাদা এসে আস্তে আস্তে শিকলটা খুলে আগেই তাড়াতাড়ি গিয়ে খাটের তলায় দইয়ের হাঁড়ি থেকে এক খাবল তুলে নিয়ে খপ করে মুখে দিয়েছে। মুখে দিয়েই চিৎকার! কথায় বলে, ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাচ্ছে, কিন্তু হরিপদর চেঁচানো তার চেয়েও সাংঘাতিক! চিৎকার শুনে মা-মাসি-দিদি-পিসি যে যেখানে ছিলেন সব ‘কি হল’ ‘কি হল’ বলে দৌড়ে এলেন। শ্যামাপদ বুদ্ধিমান ছেলে, সে দাদার চিৎকারের নমুনা শুনেই দৌড়ে ঘোষেদের পাড়ায় গিয়ে হাজির!
সেখানে অত্যন্ত ভালো মানুষের মতো তার বন্ধু শান্তি ঘোষের কাছে পড়া বুঝে নিচ্ছে। এদিকে হরিপদর অবস্থা দেখে পিসিমা বুঝেছেন যে, হরিপদ দি ভেবে তার চুনের হাঁড়ি চেখে বসেছে। তারপর হরিপদর যা সাজা! এক সপ্তাহ ধরে সে না পারে চিবোতে, না পারে গিলতে, তার খাওয়া নিয়েই এক মহাহাঙ্গামা! কিন্তু তবু তো তার লজ্জা নেই আজ আবার লুকিয়ে কোথায় লাড়ু খেতে গিয়েছে। ওদিকে মামা তো ডেকে সারা!
খানিক বাদে মুখ ধুয়ে মুছে হরিপদ ভালো মানুষের মতো এসে হাজির। হরিপদর বড় মামা বললেন, কীরে, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? হরিপদ বলল, এই তো, ওপরে ছিলাম। তবে, আমরা এত চ্যাঁচাচ্ছিলাম, তুই জবাব দিচ্ছিলি না যে? হরিপদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘আজ্ঞে জল খাচ্ছিলাম কি না। শুধু জল? না, কিছু স্থলও ছিল? হরিপদ শুনে হাসতে লাগল যেন তার সঙ্গে ভারই একটা রসিকতা করা হয়েছে।’
এর মধ্যে তার মেজো মামা মুখখানা গম্ভীর করে এসে হাজির। তিনি ভেতর থেকে খবর এনেছেন, হরিপদ একটু আগেই ভাঁড়ার ঘরে ঢুকেছিল, আর তারপর থেকেই দশ-বারোখানা ক্ষীরের লাড়ু কম পড়েছে। তিনি এসেই হরিপদর বড় মামার সঙ্গে খানিকক্ষণ ইংরাজিতে ফিসফাস কি যেন বলাবলি করলেন, তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, বাড়িতে ইঁদুরের যে রকম উৎপাত, ইঁদুর মারার একটা কিছু বন্দোবস্ত না করলে আর চলছে না। চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যারাম এই পাড়াসুদ্ধ ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।
বড়মামা বললেন, হ্যাঁ, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিদিকে বলেছি, সেঁকো বিষ দিয়ে লাড়ু পাকাতে সেগুলো একবার ছড়িয়ে দিলেই ইঁদুর বংশ নির্বংশ হবে। হরিপদ জিজ্ঞেস করল, লাড়ু কবে পাকানো হবে? বড় মামা বললেন, সে এতক্ষণে হয়ে গেছে, সকালেই টেঁপিকে দেখছিলাম একথাল ক্ষীর নিয়ে দিদির সঙ্গে লাড়ু পাকাতে বসেছে। হরিপদর মুখখানা আমসির মতো শুকিয়ে এলো, সে খানিকটা ঢোক গিলে বলল, সেঁকো বিষ খেলে কী হয় বড় মামা? হবে আবার কী? ইঁদুরগুলো মারা পড়ে, এই হয়। আর যদি মানুষে এই লাড়ু খেয়ে ফেলে?
তা একটু-আধটু যদি খেয়ে ফেলে তো নাও মরতে পারে গলা জ্বলবে, মাথা ঘুরবে, বমি হবে, হয়তো হাত-পা খিঁচবে। আর যদি একেবারে এগারোটা লাড়ু খেয়ে ফেলে? বলে হরিপদ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। তখন বড় মামা হাসি চেপে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, বলিস কীরে? তুই খেয়েছিস নাকি? হরিপদ কাঁদতে কাঁদতে বলল, হ্যাঁ বড় মামা, তার মধ্যে পাঁচটা খুব বড় ছিল। তুমি শিগগিরই ডাক্তার ডাকো বড় মামা, আমার কি রকম গা ঝিম্ঝিম্ আর বমিবমি করছে।
মেজো মামা দৌড়ে গিয়ে তার বন্ধু রমেশ ডাক্তারকে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে আনলেন। তিনি প্রথমেই খুব একটা কড়া রকমের তেঁতো ওষুধ হরিপদকে খাইয়ে দিলেন। তারপর তাকে কি একটা শুঁকতে দিলেন, তার এমন ঝাঁজ যে, বেচারার দুই চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। তারপর তারা সবাই মিলে লেপ-কম্বল চাপা দিয়ে তাকে ঘামিয়ে অস্থির করে তুললেন। তারপর একটা ভয়ানক উৎকট ওষুধ খাওয়ানো হলো। সে এমন বিস্বাদ আর এমন দুর্গন্ধ যে, খেয়েই হরিপদ ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে লাগল।
তারপর ডাক্তার তার পথ্যের ব্যবস্থা করে গেলেন। তিন দিন সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না, চিরতার জল আর সাগু খেয়ে থাকবে। হরিপদ বলল, আমি ওপরে মায়ের কাছে যাব। ডাক্তার বললেন, না। যতক্ষণ বাঁচার আশা আছে, ততক্ষণ নাড়াচাড়া করে কাজ নেই। ও আপনাদের এখানেই থাকবে। বড় মামা বললেন, হ্যাঁ, মায়ে কাছে যাবে না আরো কিছু! মাকে এখন ভাবিয়ে তুলে তোমার লাভ কী? তাকে এখন খবর দেওয়ার কিছু দরকার নেই।
তিন দিন পরে যখন সে ছাড়া পেল তখন হরিপদ আর সেই হরিপদ নেই, সে একেবারে বদলে গেছে। তার বাড়ির লোকে সবাই জানে হরিপদর ভারী ব্যারাম হয়েছিল। তার মা জানেন যে বেশি পিঠে খেয়েছিল বলে হরিপদর পেটের অসুখ হয়েছিল। হরিপদ জানে, সেঁকো বিষ খেয়ে সে আরেকটু হলেই মারা যাচ্ছিল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে কি, তা জানেন শুধু হরিপদর বড় মামা আর মেজো মামা, আর জানেন রমেশ ডাক্তার।
লেখা : সংগৃহীত
"