আবুল কালাম আজাদের হাসির গল্প
ভাইরালের দুনিয়া
কফিশপে এক নারী কফি খেতে বসেছিল। কফি এসে গেছে। কফির কাপ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। তাকে খুব সুখী মনে হচ্ছে।
নারীটা কফির কাপ হাতে নিল। কাপটা আস্তে ঠোঁটের কাছে নিল। কাপটা আলতোভাবে ঠোঁটে ছুঁইয়েই সে স্থির হয়ে গেল। কাপে চুমুক দিতে ভুলে গেল যেন। সে তাকিয়ে আছে সামনে। তার চোখ গোল ও বড় হচ্ছে। সে তাকিয়ে আছে। হাতে কফির কাপ। তার চোখ আরো বড় হচ্ছে, আরো গোল হচ্ছে।
নারীটা তাকিয়ে আছে তার সামনের টেবিলে বসা এক নায়িকার দিকে। চলচ্চিত্র নায়িকা। দেশের খুব জনপ্রিয় এক নায়িকা। সেই নারীর প্রিয় নায়িকা। এভাবে আচানক কফিশপে প্রিয় নায়িকার দেখা পেয়ে যাবে তা সে ভাবতে পরেনি- কল্পনাও করতে পারেনি।
নারীটা কফির মগ হাতে উঠে গেল। প্রিয় নায়িকার কাছে গেল। গিয়ে বলল- আপা আপনাকে দেখে আমি খুবই বিস্মিত- খুবই অবাক। আপনাকে কোনোদিন দেখতে পাব তা ভাবতে পারিনি। আমি খুবই খুশি হয়েছি।
প্রিয় নায়িকা হাসিমুখে নারীকে কাছে টেনে নিল। পাশে বসাল। আরো লোক জমে গেছে। বড়সর একটা মানববৃত্ত তৈরি হয়ে গেছে তাদের ঘিরে। তারপরই ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। এ রকম ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।
নারীটার চোখ উল্টে গেল। হাত-পা কেমন শক্ত হয়ে গেল। সে চেয়ার থেকে পড়ে গেল নিচে। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। নিশ্চয় অজ্ঞান হয়ে গেল। উপস্থিত লোকজন দিশাহারা। ডাক্তার ডাকবে, নাকি হাসপাতালে নেবে বুঝতে পারছে না। জনপ্রিয় নায়িকাও ভীত ও হতভম্ব। কেন এমন হলো? সে আবার কোনো বিপদে পড়বে না তো? সাংবাদিকরা আবার তাকে জড়িয়ে আজেবাজে কোনো খবর রটিয়ে দেবে না তো? হয়তো লিখে দিল- নায়িকা তার ভক্তকে গুলি করে ফেলে দিয়েছে।
একজন বলল- তার চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিন। তিন/চারজন পানির ঝাপটা দিতে লাগল। মানুষের ভিড় আরো বেড়ে গেছে। সাংবাদিক এসে গেছে অনেক। অনলাইন পোর্টালের রিপোর্টার, ইউটিউব চ্যানেলের রিপোর্টার, দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার। কেউ ছবি তুলছে, কেউ ভিডিও ক্লিপ নিচ্ছে। কেউ তখন তখনই নিউজ পাঠিয়ে দিচ্ছে, ভিডিও পাঠিয়ে দিচ্ছে। কী লিখে দিচ্ছে কে জানে।
যাই হোক, পানির ঝাপটা দিতে দিতে মহিলাটা চোখ মেলে তাকাল। তারপর উঠে বসল। উপস্থিত লোকজনের ভেতর স্বস্তি ফিরে এলো। সবচেয়ে বড় স্বস্তি জনপ্রিয় নায়িকার ভেতর। অল্পতে বাঁচা গেছে। একজন এগিয়ে গিয়ে বলল- আপা, আপনি হঠাৎ এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলেন কেন? মৃগীরোগ আছে নাকি?
নারীটার চোখে-মুখে কেমন হাসির ঝিলিক। একজন বলল- আপা, আপনে অজ্ঞান হয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন অথচ আপনার হাতের কফিটা পড়ল না। কফিটা ঠিক আছে, কফি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। উপস্থিত অন্যদের চোখেও পড়ল এটা। তাই তো! এ কী করে সম্ভব? অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল অথচ তার হাতের কফিটা পড়ল না!
নারীটা চোখে-মুখের হাসির ঝিলিক আরো উজ্জ্বল হলো। সে কফিতে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বলল- কীসের অজ্ঞান হইছি?
অজ্ঞান হন নাই? উপস্থিত লোকজনের বিস্মিত প্রশ্ন।
আরে নাহ, অজ্ঞান হই নাই। একটু অ্যাক্টিং করলাম।
অ্যাক্টিং?
ভাইরাল হওয়ার জন্য অ্যাক্টিং। এটা হলো ভাইরালের দুনিয়া। প্রিয় নায়িকার সঙ্গে আমার দেখা হইছে। ছবি তুলছি। যদি সেই ছবি ফেসবুকে দেই তো শুধু আমার তালিকার বন্ধুরা দেখবে। আর এখন? দেখেন গিয়ে এতক্ষণে সব অনলাইন পোর্টালে, ইউটিউবে নিউজ হয়া গেছে। হাজারে হাজারে শেয়ার হয়া গেছে। আমি ভাইরাল হয়া গেছি। প্রিয় নায়িকার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া সার্থক। এই ভাইরালের দুনিয়ায় ভাইরাল না হতে পারলে কোনো কিছুতেই লাভ নেই। আপনে ভালো গল্প-কবিতা লেখেন, আপনে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছেন, ভালো ছবি আঁকেন, আপনে অন্য কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু করেছেন কিন্তু ভাইরাল হতে পারেননি, আপনার এসব অর্জনের দুই পয়সা দাম নেই, কেউ আপনাকে পুছবে না। ভাইরাল হয়ে যান দেখবেন...।
এমন সময় একজন মোবাইল ফোন বাড়িয়ে ধরে বলল- এ দেখেন আপা, একটা পোর্টাল নিউজ করেছে- নায়িকার বুকের চাপে নারী অজ্ঞান।
এখন বুঝলেন তো? এটা হলো ভাইরালের দুনিয়া।
"