শফিক শাহরিয়ারের হাসির গল্প
ঝাল পিঠার নিমন্ত্রণ
এক গাঁয়ের নামের আদ্যাক্ষর ‘না’-বোধক শব্দ দিয়ে শুরু। না-না গাঁয়ের নামটি বলব না। এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ঘরজামাই থাকে। একটি পাড়ার নাম জামাইপাড়া। তারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে উঠে এসেছে। তাই বলে মফিজ ঘরজামাই নয়, সে সহজ-সরল পরজামাই। পরজামাই বলতে যে ঘরজামাই থাকতে নারাজ। এই গাঁয়ের সবাই আপন মানুষ। তারা যেকোনো জামাইকে নিজের জামাই ভাবেন। জামাইকে ছোট-বড় সবাই অনেক কদর করেন। যেখানে কদর আছে, সেখানে যাওয়ার গুরুত্ব বেড়েই যায়। আর যেখানে কদর নেই, সেখানে যাওয়ার দূরত্ব বেড়েই যায়। এই কদর কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। যে জামাইয়ের ঘাড়ের রগ সোজা, তার জন্য পৌষ মাস। তার কদরে কোনো কমতি নেই। আর যে ঘাড়ত্যাড়া, তার জন্য সর্বনাশ। সেখানে জামাইয়ের কদর নেই বললেই চলে।
নতুন জামাইকে বছরের প্রতি মৌসুমে নিমন্ত্রণ করতে হয়। এটাই গ্রামের চিরায়ত নিয়ম। যুগ যুগ ধরে গ্রামের মানুষ এসব নিয়ম মেনে আসছে। মফিজ সোনায় সোহাগা জামাই। এক দিন শ্বশুর মশাই তাল পিঠার নিমন্ত্রণ করতে গেলেন। সঙ্গে নিলেন মিষ্টান্ন, ফলমূল ও পাকা পাকা কয়েক হালি তাল। তার শ্বশুর জানতেন না যে, জামাই মিষ্টিজাতীয় পিঠা ও তাল পিঠা অপছন্দ করেন। তালগুলো দেখে জামাইয়ের চোখ ছানাবড়া। জামাইয়ের মেজাজ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। স্ত্রী জরিনা মফিজের মাথায় বরফ দিয়ে মেজাজ ঠাণ্ডার বৃথা চেষ্টা করে। মফিজ নির্ধারিত দিনে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেল। এবার তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। শাশুড়ি রাতে তালের বড়া বানালেন। তালের বড়া ঠিক পাখির ঠোঁটের মতো। জরিনা মফিজকে খেতে ডাকল। সে কোনো উত্তর দিল না। প্রচণ্ড গরমে তার মেজাজ চরম বিপাকে। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল। শালা-শালি ডেকেও কাজ হলো না। সারা বাড়ি যেন সুনশান। কয়েক ঘণ্টা পর জরিনা এবার ভাত খেতে ডাকে। মফিজের পেট ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে। তালের বড়া খায়নি। জরিনার রাগ বাড়তেই পারে। কথা না বাড়িয়ে ভাত খাওয়ার শেষে নিজেই মশারি টানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালের সূর্য উঁকি দিলেও মফিজের চোখ ঘুম থেকে উঁকি দিচ্ছে না। জরিনা অনেকবার ডাকছে। মফিজ নাকের আওয়াজ দিয়ে ঘুমাচ্ছে। শালা-শালি তার গায়ে পানি ছিটিয়ে দিল। তবু ওঠার নাম নেই। সে উঠছেই না। কারণ তার ঝালের পিঠা খাওয়া হয়নি। মনে মনে সে গান ধরল। এত দিনে বুঝলাম আমি কেউ কারো না...। অবশেষে শাশুড়ি ডাকলেন, জামাই ওঠো। তোমার জন্য গরম গরম মচমচে ঝালের পিঠা বানিয়েছি। এতক্ষণ ওঠোনি কেন বাবা? মফিজ বলল, আপনার মেয়ে বড়া খেতে ডেকেছে। ভাবলাম, তালের বড়া খেতে কেন ঘুম থেকে উঠব? তার চেয়ে ঘুম ভালো।
আপনি কীভাবে বুঝলেন? শাশুড়ি বললেন, সব জেনে-বুঝেই চলতে হয় বাবা। মা সবার মন জয় করে চলেন। আমার মেয়ে তালের পিঠা খাবে, আর জামাই ঝালের পিঠা খাবে। আমি সবার মা। সবার দিকেই সমান লক্ষ রাখি। মা তার মেয়ের মুখে অনেক আগেই জামাইয়ের পিঠা কাহিনি শুনেছেন। জামাই তালের পিঠা খায় না, ঝালের পিঠা খায়। শালা-শালিরা হাসতে লাগল। একসঙ্গে বলল, আমাদের ব্যতিক্রম দুলাভাই। তবে প্রিয় দুলাভাই, একটা উত্তর জানতে চাই। তুমি ঝালের পিঠা কেন এত পছন্দ করো? এর রহস্য কী? মফিজ বলল, তোমরা কেন শিঙাড়া, পেঁয়াজু, চটপটি, ফুচকা, মোগলাই ইত্যাদি পছন্দ করো? নিশ্চয় এসব জিনিস ঝালের তৈরি। তাই পছন্দ করো। সবাই খেতে চায়। নাম শুনলেই জিভে পানি আসে। তাই আমি ঝালের পিঠা পছন্দ করি। এখন থেকে বলবে- তাল পিঠার নিমন্ত্রণ নয়, ঝাল পিঠার নিমন্ত্রণ।
"