
জসীম উদ্দীনের হাসির গল্প
নাপিত ডাক্তার

ছোট্ট একটা শহর। সেখানে সবচেয়ে বড় ডাক্তার হইয়া পড়িল এক নাপিত। ছোটখাটো অসুখে এটা-ওটা ওষুধ দিয়াই নয়, ফোঁড়া কাটা হইতে আরম্ভ করিয়া রোগীর পেট চিরিয়া পেট হইতে পুঁজ বাহির করিয়া দেওয়া পর্যন্ত বড় বড় কাটাছেঁড়ার কাজও সে অতি সহজেই করিয়া দেয়।
এসব কাজ করিতে ডাক্তাররা কত রকমের যন্ত্র লয়। ছুরি, কাঁচি ভালোমতো গরম পানিতে সেদ্ধ করিয়া, পানিতে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করিয়া কত সাবধান হইয়া তাহারা রোগীর গায়ে অস্ত্র ধরে।
নাপিত কিন্তু এসবের ধার ধারে না। সে হাতের তলায় তাহার ক্ষুর আর নরুন ভালোমতো ঘষিয়া খসাখস বড় বড় কাটাছেঁড়ার কাজ করিয়া যায়। এমন পাকা তাহার হাত : রোগীর পেট চিরিয়া, পেটের মধ্যে হাত দিয়া, সেখানে নাড়ির ভেতরে ফোঁড়াটি হইয়াছে, অতি সহজেই সেখানে ক্ষুর চালাইয়া পুঁজরক্ত বাহির করিয়া আনে। তারপর সাধারণ সুঁই-সুতা দিয়া ক্ষতস্থান সেলাই করিয়া, আর একটু হলুদের গুঁড়ো মাখাইয়া দেয়। ক্ষতস্থান সারিয়া যায়। চোখের পলক ফেলিতে না ফেলিতে সে বড় বড় কাটাছেঁড়ার কাজ করিয়া ফেলে। কাহারও ফোঁড়া হইয়াছে, বেদনায় চিৎকার করিতেছে। দেখি, দেখি বলিয়া নাপিত সেখানে তার ক্ষুর চালাইয়া দিয়া পুঁজরক্ত বাহির করিয়া আনে। রোগী আরাম পাইয়া আনন্দের হাসি হাসে। গলায় মাছের কাঁটা ফুটিয়াছে, দুষ্ট ছেলে খেলিতে খেলিতে মারবেলগুলো কানের মধ্যে ঢোকাইয়া দিয়াছে, আর খুলিতে পারে না। নাপিত নরুনের আগা দিয়া গলার ভিতর হইতে মাছের কাঁটা বাহির করিয়া আনে, কানের ভিতরে নরুনের আগা ঢোকাইয়া দিয়া মারবেল বাহির করিয়া আনে। শুধু কি তাই? পিঠে ফোঁড়া হইলে তাকে বলে কারবঙ্কল। বড় বড় ডাক্তার সেটা কাটিতে হিমশিম খাইয়া যায়। চোখের পলক ফেলিতে ফেলিতে নাপিত সেখানে ক্ষুর চালাইয়া দেয়।
এসব কাটাকুটিতে সব রোগীই কি ভালো হয়? কোনোটা ভালো হয়, কোনোটা পাকিয়া বিষ লাগিয়া ফুলিয়া মরে। তা এরূপ তো ডাক্তারের বেলায়ও হয়। তাদের হাতেই কি সব রোগী ভালো হয়?
শহরের সব লোক তাই অসুখে-বিসুখে নাপিতকেই ডাকে। ডাক্তার ডাকিলে এত টাকা দাও, অত টাকা দাও, তারপর ওষুধের দাম দাও। কত রকমের ঝামেলা। নাপিতের কাছে ভিজিটের কোনো দামণ্ডদস্তুর নাই। দু-আনা, চারআনা যার যাহা খুশি দাও। ওষুধ তো তার মুখে মুখে, গরম পানির সেঁক, হলুদের গুঁড়োর প্রলেপ, পেটে অসুখ করলে আদা-নুন খাও, তাতে না সারিলে জইনের গুঁড়ো চিবাও, জ্বর হইলে তুলসীর পাতা, নিউমোনিয়া হইলে আকনের পাতার সেঁক। এসব ওষুধ বনে-জঙ্গলে, পথে-ঘাটে যেখানে-সেখানে মেলে। তাই সবাই নাপিতকে দিয়ে চিকিৎসা করায়।
শহরের আর আর সব পাস করা ডাক্তাররা রোগীর অভাবে ভাতে মরে। নাপিতের মেয়েছেলে দুধে ভাতে খাইয়া নাদুসনুদুস। এক দিন সব ডাক্তার একত্র হইয়া ভাবিতে বসিল, কী করিয়া তাদের পসার ফিরাইয়া আনা যায়।
এক ডাক্তার বলে, ‘দেখো ভাই। আগে আমার বাড়িতে রোজ সকালে শত শত রোগী আসিয়া গড়াগড়ি দিত। টাকাণ্ডপয়সা তো দিতই, সেই সঙ্গে রোগ সারিলে কলাটা মূলটা, যে দিনের যে, তাও দিয়া যাইত। এই যে আমের মৌসুম। আমার ছেলেমেয়েরা একটা আমও মুখে দিয়ে দেখিল না! আর নাপিতের বাড়ি দেখো গিয়ে আর এক ডাক্তার বলে, ‘আরে ভাই! ছাড়িয়া দাও তোমার আম খাওয়া। রোগীপত্তর আসে না। টাকাণ্ডপয়সার অভাবে এবার ভাবিয়াছি, ওষুধ মাপার পালা-পাথর, আর বুক দেখার টেথিস্কোপটা বেচিয়া ফেলিব।’
অপর ডাক্তার উঠিয়া বলে, ‘তুমি তো এখনো বেচো নাই। এই দুর্দিনের বাজারে চাউলের যা দাম! ডাক্তারি যন্ত্রপাতি তো কবেই বেচিয়া খাইয়াছি। এবার মাথার ওপরে টিনের চালা কয়খানা আছে। তাও বেচিবার লোক খুঁজিতেছি।’
ওপাশের ডাক্তার বলে, ‘ভায়া, হে, এসব দুঃখের কথা আর বলিয়া কী হইবে, দেখিতেছ না? আমাদের সকলের অবস্থাই ওই একই রকম। এখন কী করা যায় তাই ভাবিয়া বাহির করো।’
আরেক ডাক্তার বলে, ‘দেখো ভাই! বিপদে পড়লে বুড়ো লোকের পরামর্শ লইতে হয়। শহরের মধ্যে যে বুড়ো ডাক্তার আছেন, বয়স হইয়াছে বলিয়া এখন রোগী দেখেন না। তিনি আমাদের সবার ওস্তাদ। চলো যাই, তাহার নিকটে যাইয়া একটা বুদ্ধি চাই; কি করিয়া আমাদের পূর্বের পসার বজায় রাখিতে পারি।’
তখন সবাই মিলিয়া সেই বুড়ো ডাক্তারের কাছে যাইয়া উপস্থিত হইল। বুড়ো ডাক্তার আগাগোড়া সমস্ত শুনিয়া বলিলেন, ‘তোমরা কেহ সেই নাপিতকে আমার নিকট ডাকিয়া আনো।’
নাপিত আসিলে বুড়ো ডাক্তার তাহাকে বলিলেন, ‘দেখো এইসব ছোকরা ডাক্তারের কাছে শুনিতে পাইলাম, তোমার কাটাছেঁড়ার হাত পাকা। তুমি একটা কাজ করো। আমাদের নিকট হইতে শারীর বিদ্যাটা শিখিয়া লও। তাতে করিয়া তোমার ডাক্তারি বিদ্যাটা আরও পাকিবে।’
নাপিত বলিল, ‘এ অতি উত্তম কথা। আমি তো মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। আপনারা যদি কিছু শিখাইয়া দেন বড়ই উপকার হইবে।’
তখন সব ডাক্তার মিলিয়া নাপিতকে শারীর বিদ্যা শিখাইতে লাগিল। শরীরের এখান দিয়া এই নাড়ি প্রবাহিত হয়। এইটা শিরা, এইটা উপশিরা। এইখানে ধমনি। এইখানে লিভার। হাতের এইখানে এই শিরা। কাটিলে রক্ত বন্ধ হইবে না, লোক মরিয়া যাইবে। এইখানে হৃৎপিন্ড। এইভাবে সাত-আট দিন ধরিয়া সব ডাক্তার মিলিয়া নাপিতকে শারীর বিদ্যা শিখাইতে লাগিল। নাপিত বুদ্ধিমান লোক। ডাক্তারদের যাহা শিখিতে মাসের পর মাস লাগিয়াছিল, সে তাহা সাত দিনে শিখিয়া ফেলিল। শুধু কি শারীর বিদ্যা? ডাক্তাররা তাহাকে নানা রকম অসুখের জীবাণুর কথাও বলিয়া দিল। ডাক্তারি যন্ত্রপাতি ভালোভাবে পরিষ্কার করিয়া না লইলে রোগীর কী কী রোগ হইতে পারে তাহাও বোঝাইয়া দিল।
তারপর সেই বুড়ো ডাক্তারের পরামর্শমতো সব ডাক্তার একটি রোগী আনিয়া নাপিতের সামনে খাড়া করিল। তাহার সামান্য ফোঁড়া হইয়াছিল। তাহারা তাকে সেই ফোঁড়া কাটিতে বলিল।
নাপিত কত রকম করিয়া হাত ধোয়। কত ওষুধ গোলাইয়া তার ক্ষুর-নরুন পরিষ্কার করে, কিন্তু তার মনের খুঁতখুঁতি যায় না। হয়তো তার হাত ভালোভাবে পরিষ্কার হয় নাই। হয়তো অস্ত্রে কোনো রোগের জীবাণু লাগিয়া আছে। আবার নতুন করিয়া অস্ত্র সাফ করিয়া নাপিত সেই লোকটির ফোঁড়া কাটিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু তার হাত যে আজ কাঁপিয়া ওঠে। শরীরের এইখানে এই শিরা এইখানে উপশিরা। ওইখান দিয়ে ক্ষুর চালাইলে রোগী মারা যাইবে; নাপিত ক্ষুর এভাবে ধরে, ওভাবে ধরে, কিন্তু ফোঁড়া কাটিতে কিছুতেই সাহস পায় না। এত দিন অজানাতে রোগীর গায়ের যেখানে-সেখানে ক্ষুর চালাইয়াছে। কিন্তু সমস্ত জানিয়া শুনিয়া সে আজ রোগীর গায়ে ক্ষুর চালাইতে সাহস পায় না। ভয়ে তাহার হাত হইতে অস্ত্র খসিয়া পড়িয়া গেল। নাপিত আর তাহার ক্ষুর চালাইতে পারিল না।
"