reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৮ জানুয়ারি, ২০২৩

জসীম উদ্দীনের হাসির গল্প

চুক্তি

গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড়লোক আমাদের খাঁ সাহেব; কিন্তু বড়ই কৃপণ। একটি পয়সাও তার হাতের কানি আঙুল গড়িয়ে পড়ে না। তার বাড়িতে কেহ কোনো দিন দাওয়াত খেতে পায় না।

সেবার তার ছেলের বিবাহ। সব গ্রামের লোক এসে ধরল, ‘খাঁ সাহেব! এবার আর আপনাকে ছাড়ব না; আপনার ছেলের বিবাহ। আমাদিগকে দই চিনি খাওয়াতে হবে।’

খাঁ সাহেব অনেক ওজর আপত্তি করল, ‘এ বছর খেতের ধান তেমন হয় নাই। পাটের দামও কম। দই-চিনিটা বাদ দাও। আমি তোমাদের মাছ-ভাত খাওয়াব।’

গ্রামের লোকেরা কি আর তা মানে? অগত্যা খাঁ সাহেবকে রাজি হতে হলো। কিন্তু গ্রামের সব লোককে দই-চিনি খাওয়াতে গেলে অনেক টাকা খরচ হবে। সারা রাত এই খরচের চিন্তায় তার ঘুম হলো না। শেষ রাতে খাঁ সাহেব মনে মনে একটি ফন্দি আঁটল।

সকাল হলে সে মতি গোয়ালার বাড়ি গিয়ে তাকে ঘুম হতে জাগাল। মতি চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞাসা করল, ‘তা খাঁ সাহেব কী মনে করে?’

খাঁ সাহেব বলল, ‘দেখ মতি! কাল আমার ছেলের বিয়ে। তোমাকে ১০ মণ দই করে দিতে হবে।’

মতি খুশি হয়ে বলল, ‘সে আর এমন বেশি কথা কী, আমি ঠিক সময়ে দই বানিয়ে হাজির হব।’

খাঁ সাহেব গোয়ালাকে আরো একটু নিকটে ডেকে বলল, ‘দেখ মতি। এর মধ্যে আমার একটি কথা আছে। তুমি আমাকে এক মণ মিষ্টি দই বানিয়ে দিবে। আর বাদ বাকি ৯ মণ দই টক করে তৈরি করবে।’

মতি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘খাঁ সাহেব। সবাই তো মিষ্টি দই চায়। আপনি টক দই চান কেন?’

খাঁ সাহেব হেঁসে বলল, ‘দেখ মতি। তুমি বুঝবে না। তুমি যদি আমাকে সব মিষ্টি দই দাও, তবে ১০ মণে কুলাবে না। গ্রামবাসীরা যেভাবে রাক্ষসের মতো খায়, ২০ মণ দই না হলে তাদের পেট ভরাতে পারব না। সে অনেক টাকার খরচ।’

গোয়ালা হেঁসে বলল, ‘আচ্ছা। আপনি যেভাবে বলছেন, সেভাবেই দই তৈরি করব।’

খাঁ সাহেব গোয়ালার কানে কানে বলল, ‘দেখ মতি। আরো একটা কথা, তোমার টক দই খেয়ে গ্রামের লোকেরা যখন নিন্দা করবে, তখন আমি তোমাকে খুব বকব। কিন্তু তুমি একটি কথাও বলতে পারবে না। এজন্য আমি তোমার টক দইয়ের প্রতি মণের দামে আরো চার আনা করে ধরে দিব। মনে থাকে যেন, আমি টক দই আনার জন্য তোমাকে যতই গালাগালি করব, তুমি টু শব্দটিও করবে না।’

মতি হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’

নিমন্ত্রণের দিনে গ্রামের লোক খেতে এসেছে। মাছ-ভাত খাওয়ার পর প্রত্যেকের পাতে যখন মিষ্টি দই পড়ল; তখন সবাই খাঁ সাহেবের তারিফ করতে লাগল। কিন্তু এক চামচ দুই চামচ করে যখন পাতে পাতে টক দই পড়তে লাগল, তখন সব লোকের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। কেউ খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ল, কেউ খাঁ সাহেবকে গালি দিতে লাগল।

খাঁ সাহেব তখন গোয়ালাকে ডেকে খুব রাগের সঙ্গে বলল, ‘দেখ। তুমি এত টক দই দিয়েছ কেন?’

গোয়ালা কোনো কথা বলে না। খাঁ সাহেব গলা আরো চড়িয়ে বলে, ‘কি, এখন যে মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। বেটা পাজি নচ্ছার এত টাকা দাম নিয়ে আমাকে টক দই দিয়েছিস? দাঁড়া, তোকে আমি মজা দেখাচ্ছি।’

গোয়ালা তখনো কোনো কথা বলে না।

খাঁ সাহেব আরো রেগে বলে, ‘বেটা পাজি নচ্ছার! ভেবেছিস তোকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিব? এত লোকের খাওয়া নষ্ট করলি, তার শাস্তি তোকে দিব না?’

তাকে এইভাবে বকতে বকতে খাঁ সাহেবের মাথা গরম হয়ে উঠল। রাগের মাথায় গোয়ালার মুখে বিরাশির দশ আনা ওজনের এক থাপ্পড় মেরে বসল।

মার খেয়ে গোয়ালা নিমন্ত্রিত লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলল, ‘দেখেন, সব লোকজন আপনারা দশ জনে ইহার বিচার করেন। খাঁ সাহেব কোরান শরিফ মাথায় নিয়ে বলুন, দই টক হলে আপনারা কম খাবেন, তাই আমাকে টক দই আনার জন্য বায়না দিয়েছিলেন কি-না।’

শুনে গাঁয়ের সব লোক খাঁ সাহেবের ওপর ভীষণ চটে গেল। খাঁ সাহেবের মেজাজ নরম হয়ে এলে কানে কানে আস্তে গোয়ালাকে বলল, ‘কিরে মতি, তোর সঙ্গে কথা হয়েছিল না, টক দই দেখে আমি খুব রাগারাগি করব, তুই কিছু বলবি না? এখন কেন সকল কথা ফাঁস করে দিলি?’

গোয়ালা আরো আস্তে আস্তে খাঁ সাহেবকে বলল, ‘আপনার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, আপনি যতই গালাগালি করবেন, যতই আমাকে বকবেন, ধমকাবেন আমি টু শব্দটিও করব না। যতক্ষণ আপনি রাগারাগি করতে থাকবেন আমি কিছুই বলব না। কিন্তু আপনি আমার মুখে বিরাশির দশ আনার একটি থাপ্পড় মারলেও যে আমি কথা বলব না, এ কথা তো চুক্তিতে ছিল না।’ গ্রামের সব লোকের কাছে খাঁ সাহেবের মাথা হেঁট হলো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close