reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সুকুমার রায়ের হাসির গল্প

হাসির গল্প

আমাদের পোস্টাপিসের বড়বাবুর বেজায় গল্প করিবার সখ। যেখানে-সেখানে সভায় আসরে নিমন্ত্রণে, তিনি তাহার গল্পের ভাণ্ডার খুলিয়া বসেন। দুঃখের বিষয়, তার ভাণ্ডার অতি সামান্য- কতগুলো বাঁধা গল্প, তাহাই তিনি ঘুরিয়া ফিরিয়া সব জায়গায় চালাইয়া দেন। কিন্তু একই গল্প বারবার শুনিতে লোকের ভালো লাগিত কেন? বড়বাবুর গল্প শুনিয়া আর লোকের হাসি পায় না। কিন্তু তবু বড়বাবুর উৎসাহও তাহাতে কিছুমাত্র কমে না।

সেদিন হঠাৎ তিনি কোথা হইতে একটা নুতন গল্প সংগ্রহ করিয়া, মুখুজ্জেদের মজলিসে শুনাইয়া দিলেন। গল্পটা অতি সামান্য কিন্তু তবু বড়বাবুকে খাতির করিয়া সকলেই হাসিল। বড়বাবু তাহা বুঝিলেন না, তিনি ভাবিলেন গল্পটা খুব লাগসই হইয়াছে। সুতরাং তার দুদিন বাদে যদু মল্লিকের বাড়ি নিমন্ত্রণে বসিয়া, তিনি খুব আড়ম্বর করিয়া আবার সেই গল্প শুনাইলেন। দু-একজন যাহারা আগে শোনে নাই, তাহারা শুনিয়া বেশ একটু হাসিল। বড়বাবু ভাবিলেন গল্পটা জমিয়াছে ভালো।

তারপর ডাক্তারবাবুর ছেলের ভাতে তিনি আবার সে গল্পই খুব উৎসাহ করিয়া শোনাইলেন। এবারে ডাক্তারবাবু ছাড়া আর কেহ গল্প শুনিয়া হাসিল, না, কিন্তু বড়বাবু নিজেই হাসিয়া কুটি কুটি। তারপরও যখন তিনি আরো দু-তিন জায়গায় সেই একই গল্প চালাইয়া দিলেন, তখন আমাদের মধ্যে কেহ কেহ বিষম চটিয়া গেল। বিশু বলিল, ‘না হে, আর তো সহ্য হয় না। বড়বাবু বলে আমরা এত দিন সয়ে আছি- কিন্তু ওর গল্পের উৎসাহটা একটু না কমালে চলছে না।’

দুদিন বাদে, আমরা দশ-বারোজন বসিয়া গল্প করিতেছি, এমন সময় বড়বাবুর নাদুসনুদুস মূর্তিখানা দেখা দিল। আমরা বলিলাম, ‘আজ খবরদার! ওর গল্প শুনে কেউ হাসতে পাবে না! দেখি উনি কি করেন।’ বড়বাবু বসিতেই বিশু বলিয়া উঠিল, ‘না, বড়বাবু আজকাল যেন কেমন হ’য়ে গেছেন। আগে কেমন মজার মজার সব গল্প বলতেন। আজকাল, কৈ? কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন।’ বড়বাবু একথায় ভারী ক্ষুণ্ন হইলেন। তার গল্প আর আগের মতো জমে না, এ কথাটি তাহার একটুও ভালো লাগিল না। তিনি বলিলেন, ‘বটে? আচ্ছা রোস। আজ তোমাদের এমন গল্প শোনাব, হাস্?তে হাস্?তে তোমাদের নাড়ি ছিঁড়ে যাবে।’ এই বলিয়া তিনি তাহার সেই মামুলি পুঁজি হইতে একটা গল্প আরম্ভ করিলেন। কিন্তু গল্প বলিলে কী হইবে? আমরা কেহ হাসিতে রাজি নহি- সকলেই কাঠ হইয়া বসিয়া রহিলাম। বিশু বলিল, ‘না, এ গল্পটা জুতসই হলো না।’ তখন বড়বাবু তাহার সেই পুঁজি হইতে একে একে পাঁচ-সাতটি গল্প শুনাইয়া দিলেন। কিন্তু তাহাতে সকলের মুখ প্যাঁচার মতো আরো গম্ভীর হইয়া উঠিল! তখন বড়বাবু ক্ষেপিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন, ‘যাও যাও! তোমরা হাসতে জান না- গল্পের কদর বোঝ না আবার গল্প শুনতে চাও! এই গল্প শুনে সেদিন ইনস্পেক্টার সাহেব পর্যন্ত হেসে গড়াগড়ি- তোমরা এসব বুঝবে কী?’ তখন আমাদের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিল, ‘সে কি বড়বাবু? আমরা হাসতে জানিনে? বলেন কি! আপনার গল্প শুনে কতবার কত হেসেছি, ভেবে দেখুন তো’। আজকাল আপনার গল্পগুলো তেমন খোলে না তা হাসব কোত্থেকে? এই ত, বিশুদা যখন গল্প বলে তখন কি আমরা হাসিনে? কী বলেন?’

বড়বাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘বিশু? ও আবার গল্প জানে নাকি? আরে, একসঙ্গে দুটো কথা বলতে ওর মুখে আটকায়, ও আবার গল্প বলবে কি?’ বিশু বলিল, ‘বিলক্ষণ! আমার গল্প শোনেননি বুঝি?’ আমরা সকলে উৎসাহ করিয়া বলিলাম- ‘হা, হা, একটা শুনিয়ে দাও তো।’ বিশু তখন গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘এক ছিল রাজা’- শুনিয়া আমাদের চার-পাঁচজন হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘আরে রাজার গল্প রে রাজার গল্প!- হা হা হা হা।’

বিশু বলিল, ‘রাজার তিনটা ধাড়ি ধাড়ি ছেলে’-

শুনিবামাত্র আমরা একসঙ্গে প্রাণপণে এমন সশব্দে হাসিয়া উঠিলাম যে, বিশু নিজেই চমকাইয়া উঠিল। সকলে হাসিতে হাসিতে, এ উহার গায়ে গড়াইয়া পড়িতে লাগিলাম- কেহ বলিল, ‘দোহাই বিশুদা, আর হাসিও না’- কেহ বলিল, ‘বিশুবাবু রক্ষে করুন, ঢের হয়েছে।’ কেহ কেহ এমন ভাব দেখাইল, যেন হাসিতে হাসিতে তাহাদের পেটে খিল ধরিয়া গিয়াছে।

বড়বাবু কিন্তু বিষম চটিয়া গেলেন। তিনি

বলিলেন, ‘এসব ওই বিশুর কারসাজি। ওই আগে থেকে সব শিখিয়ে এনেছে। নইলে, ও যা বললে তাতে হাসবার মতো কী আছে বাপু?’ এই বলিয়া তিনি রাগে গজগজ? করিতে করিতে উঠিয়া গেলেন।

সেই সময় হইতে বড়বাবুর গল্প বলার শখটা বেশ একটু কমিয়াছে। এখন আর তিনি যখন-তখন কথায় কথায় হাসির গল্প ফাঁদিয়া বসেন না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close