স্বপ্না রেজা
স্বপ্নের সেতু পদ্মা সেতু
পদ্মা সেতু ও একজন শেখ হাসিনা
রাজনীতিকে ভয় করে সাধারণ জনগণ। মারামারি, খুনাখুনি, প্রতিহিংসা চলমান আচরণ রাজনীতির। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা কমেছে জনগণের। ভোটে তাই ভোট পড়ে কম, ভোটারের চেয়ে ভোট অনেক কম। ইভিএম নিয়ে বিএনপির যতই বিরোধিতা চলুক, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটাতে পারেনি দলটি। ইভিএম পদ্ধতিতে তাদের প্রার্থী জয়ী হলেও জয় প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানা নেই। যা হোক, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া দলের কোনো উল্লেখ করার মতো আন্দোলন ছিল বলে কেউ মনে করতে পারবেন কি না সংশয় আছে। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আওয়াজ দিতে শুরু করেছে। করোনাকালীন তাদের মানবিক কর্মসূচি ছিল বলে কোনো মিডিয়ায় তা দৃশ্যমান হতে দেখা যায়নি। নিজেরাও করেছে বলে মনে পড়ে না। যদিও সরকারের ত্রাণ, অনুদান বিতরণ নিয়ে সমালোচনা করেছে দলটি লাগাতার। উপরন্তু সরকারের ভ্যাকসিন বিষয়টি নিয়েও তারা বিরোধিতা করেছে। বিএনপিপন্থি অনেককেই করোনা ভ্যাকসিন সম্পর্কে নেতিবাচক, ক্ষতিকর বক্তব্য, মন্তব্য করতে দেখা গেছে। ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলেছে। যদিও এই অতিমারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক এবং পন্থিদের ভ্যাকসিন নিতে দেখা গেছে। কথা যা বলেছে ও বাস্তবে যা করেছে তাতে দ্বৈততা ছিল। অনেকে বলেন, অতিমারির সময়ে দলটি মানবিক কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। রাজনৈতিক কার্যকলাপ, যেমন- মিছিল, সভা-সমাবেশে ক্ষমতাসীন সরকার বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুললেও করোনাকালীন দলটির কোনো মানবিক কর্মসূচিতে সরকার বাধা দিয়েছে, এমন অভিযোগও ওঠেনি যতদূর মনে পড়ে। বিএনপি ত্রাণ বা অনুদান দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে এমন তথ্য অনেকেরই জানা নেই। ফলে করোনাকালীন জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে সরকারের কাজের প্রতি দলটির বিরোধিতামূলক আচরণটি বেশ দৃশ্যমান ছিল।
বিরোধিতা করতে করতে দলটি এখন পদ্মা সেতুরও বিরোধিতা করতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজনকে বলতে শুনলাম, তিনি পদ্মা সেতুতে উঠবেন না। কারণ পদ্মা সেতুতে হাজার টাকার দুর্নীতি আছে। দলটির বড়সড় নেতাও পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভেযোগ তুলছেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে, স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের কোথাও কোনো দুর্নীতি হলেই স্বাধীনতাকে কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করিয়ে ফেলতে হবে। আবার বিএনপি এমন ভঙ্গিতে, ভাষায় কথা বলছে যে, মনে হয় আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক ও পন্থিরা দুর্নীতি শব্দটার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়েছে। তাদের শাসনামল ও হাওয়া ভবনের ইতিহাস তারা সবাই বেমালুম ভুলে গেছে। যাই হোক, দুর্নীতির কমবেশি স্বাক্ষর সব সরকার আমলেই ছিল এবং থেকে যায়। শুধু ক্ষমতায় অবস্থান করেই কেউ দুর্নীতি করে না, ক্ষমতার বাইরে থেকেও দুর্নীতি করে। মনমানসিকতা, মূল্যবোধের অভাব, বিলম্বিত বিচারব্যবস্থা, বিচার না হওয়া, কাজে দায় ও জবাবদিহি না থাকাই দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম কারণ।
নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টা একজন শেখ হাসিনা। এই পদ্মা সেতু নির্মাণে কঠোর অবস্থান নিয়ে তিনি বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশকে অহঙ্কার করার, গর্ব করার একটি জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, যা মুক্তিযুদ্ধের আদল বহন করে, মনে করিয়ে দেয়। একজন যোগ্য নেত্রী তিনি। তবে সেই নেতৃত্ব দলের চেয়েও বেশি দৃশ্যমান বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার। তার সাহসিকতার পরিচয় অতীতেও পেয়েছি। বিদেশি শক্তির সাদা চামড়ার কাছে তিনি মাথা নত না করে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের তিনি বিচার করেছেন, ফাঁসি কার্যকর করেছেন। বৈশি^ক অবস্থায় এটা ছিল অত্যন্ত সাহসিকতার একটি কাজ। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। জামায়াত-শিবিরের পক্ষে, স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিদেশি শক্তির লম্বা ও শক্ত হাত ছিল। শেখ হাসিনা বাংলার মাটিকে কলঙ্কমুক্ত করতে দৃঢ়প্রত্যয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি তার প্রত্যয় প্রমাণ করেছেন। বিএনপি তখন শেখ হাসিনার পাশে ছিল না। বরং দলটির ভূমিকা নিয়ে সংশয় ও প্রশ্নের অবতারণা হয়। জনগণের একাংশ মনে করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না চাওয়াটা দলটির অবস্থান স্বাধীনতার সপক্ষে নয় কোনোভাবেই। দলটির অভ্যন্তরে এখনো প্রাদেশিক চিন্তা, চেতনা কাজ করছে হয়তো বা।
একমাত্র বোন ছাড়া পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শেখ হাসিনা সেই দিন যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক হতে উদ্বুদ্ধ করেছে, দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সাহস জুগিয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরও তিনি ভীত ছিলেন না। সেই শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নিয়ে পুনরায় লড়াইতে নেমেছেন। দুর্নীতির বৈদেশিক অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তিনি দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে আজ (২৫ জুন)। শাবাশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! আপনি দেখিয়ে দিয়েছেন বাঙালি জাতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে। যখন পদ্মার বুকে সেতুর ছবি ভেসে উঠতে দেখি, তখন লাখো-কোটি বাঙালির হাসি দেখি। চলাচলে সহজ ও নির্বিঘœতা জীবনকে কত সহজ করে দেয়, স্বপ্ন দেখায় নতুন নতুন তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। শিক্ষাগ্রহণ, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি জীবন যেসব কাজকে কেন্দ্র করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায় এই পদ্মা সেতু যেন সেসব বার্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পদ্মা পাড়ের একজনকে বলতে শুনলাম, রাতে সুখে আর চোখের পাতা বন্ধ হয় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ আর অসম্ভব কিংবা অনেক সময়ের কোনো ব্যাপার হয়ে রইল না। রাতারাতি এর ফল দেখা যাবে না ততটা, যতটা না দেখা যাবে কদিন পর। আবার কিছু সাফল্য হয়তো চোখে দেখা যাবে না। কিন্তু সমষ্টিগত উন্নয়নে নীরব ছাপ ফেলে যাবে এবং তা অনেক বেশি।
শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণে যে ভূমিকা রেখেছেন তাতে তার অবস্থান ছিল তার নিজস্ব রাজনৈতিক দলেরও ঊর্ধ্বে। তিনি বাংলাদেশের একজন যোগ্য অভিভাবক হিসেবে তার চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন নিঃসন্দেহে। যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস রাখেন, স্বাধীন রাষ্ট্রের সব নাগরিক সুবিধা ভোগ করেন, তাদের এই সত্য অকপটে স্বীকার করতে হবে। যখন রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি-গোষ্ঠীস্বার্থে রাজনৈতিক তৎপরতা সক্রিয় রাখে, দলের অস্তিত্ব প্রমাণে সচেষ্ট থাকে তখন ‘একটি পদ্মা সেতু’ নির্মাণের ইতিহাস অনেক কথা বলে দেয়। বলে দেয় একজন শেখ হাসিনা দলের চেয়ে দেশকেই বেশি ভালোবাসেন। সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন। এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিমত। এমন অভিমতের পেছনে আরো কারণ রয়েছে। তাকে নিজ দলের নেতিবাচক ব্যক্তির সমালোচনা যেমন প্রকাশ্যে করতে দেখেছি, বিচারের আওতায় আনতে দেখেছি তা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার মতো মানুষের হয়নি।
পরিশেষে বলব, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জনগণের জন্য নির্মিত। সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলেরই বিরোধিতামূলক কোনো কথা, বক্তব্যতে কিছু যায় আসে না। এসব দল থাকবে না। কিন্তু পদ্মা সেতুতে জনগণের জীবনের যে ইতিবাচক পরিবর্তন তৈরি হবে, রচিত হবে তা রয়ে যাবে এক বংশ থেকে বহু বংশ।
কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা একজন শেখ হাসিনাকে! সৃষ্টিকর্তা তার দীর্ঘায়ু দিন। বাঙালি জাতি আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেঁচে থাকুক। তরুণ প্রজন্ম বুঝুক, পদ্মা সেতু সেই আত্মসম্মানবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা শেখ হাসিনা দ্বারা রচিত। সত্যের জয় হোক। সত্য বেঁচে থাকুক নির্মলতায়, আস্থায় এবং জীবন চর্চায়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
"