জান্নাতুন নিসা

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

একুশের গানে প্রাণের ঐকতান

বি বর্ণ সৌন্দর্যের গেরুয়া সিঁথিতে বাগ্মীতার আসর ছিন্ন করে বিস্মিত কানাকানি, ঐশী উন্মাদনায় কল্যাণী সিমান্তে বরাবরই তুলেছে-অন্তর্ভেদী সুর। যে সুরের ঝরঝরে ছন্দে প্রতিশ্রুত তাল এবং লয় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে মানব মানসে, পূর্ণ করেছে আমাদের গানের ডালী। আর সুরেলা আহ্বানে গানের মাঝেই স্বপ্ন কুড়িয়েছে ভাজখোলা রোদ্দুর। তাই বুঝি জীবনের ঐকতানে বিলাসী অভিঘাতের হাত ধরে বাঙালি জীবনে গান হয়ে উঠেছে উজ্জীবিত জীবনের সঞ্জীবনী। বাঙালির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে গান যেন- ঘাতকের বিনাশধ্বনি, প্রলয়ডঙ্কা। বাঙালির যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছে শত-সহস্র গান। বাংলা ভাষায় যুগে যুগে রচিত হয়েছে অনেক গান; আর ১৯৪৮ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের প্রথমপর্ব থেকে ভাষার গান রচনা শুরু হয়। এই গান আন্দোলনকে একদিকে যেমন বেগবান করেছে, প্রেরণা যুগিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছে নতুন মাত্রায় সৃষ্টির জয়গানে কিংবা দেশমাতৃকার টানে এগিয়ে যেতে; এমনকি বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনে বীরসেনানী হতেও গানের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। গানের উৎসমূল এই যে ভাষা, এই ভাষা নিয়ে বিরল হলেও রয়েছে আন্দোলন, রক্তাক্ত সংগ্রাম; আর বাংলা ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন-সংগ্রাম, পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।

সেই সুবাদে বাঙালি জাতির ভাষার প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ, আন্তরিকতা এসব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মায়ের ভাষার প্রতি আকুতির এক অপরূপ দৃষ্টান্ত আমাদের অমর একুশ। ভাষার জন্য অকুতোভয় বাঙালি কী করে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, তা আজ আর কারো অজানা নয়। ইউনেস্কো ও জাতিসংঘের বদৌলতে এই দিনটি আমরা ভাগ করে নিয়েছি পুরো পৃথিবীর সঙ্গে। আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকারে পৃথিবীর সমগ্র দেশ আজ একীভূত। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা নদী মাতৃক আমাদের এই দেশটি খুব ছোট হলেও আমাদের গর্জন অনেক বড়। সেই গর্জনের প্রাপ্তিও অনেক যা পৃথিবীকে আজও অবাক করে দেয়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়- ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/অবাক তাকিয়ে রয়;/জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ বাঙালি মাথা নত করেনি, তাইতো আধিপত্যবাদকে দুমড়ে-মুচড়ে ছিনিয়ে এনেছে মা-কে মা বলার অধিকার, আমরা পেয়েছি আমাদের স্মৃতির শহীদ মিনার। বুকভরা ভালোবাসায় যে শহীদ মিনারে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভুলিতে পারি’ গানের সঙ্গে নগ্ন পায়ে, স্নিগ্ধচিত্তে, হাতে ফুল; বাঙালির প্রাণের আকুতি হয়ে উঠেছে। যুগে যুগে সেই আকুতির হাত ধরে স্মৃতিরা ডানা ঝাপটায় এই সুরের ঐকতানে।

ভাষাকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম গানটি রচনা করেন কবি ও গীতিকার অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী (১৯১৯-২০০৯)। এতে সুরারোপ করেন প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান (১৯২১-১৯৯৪)। ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণের আকুতি শুরু হয়। সেই টানেই বোধকরি অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী, সেই রাতেই ভাষার জন্য প্রথম গানটি রচনা করেন- ‘শোনেন হুজুর-/বাঘের জাত-এই বাঙালীরা-/জান দিতে ডরায় না তারা,/তাদের দাবী বাংলা ভাষা/আদায় করে নেবে তাই।’ তিনি পরে আরো রচনা করেন- ১. ‘বাংলার বুকের রক্তে রাঙানো আটই ফাল্গুন/ভুলতে কী পারি শিমুলে পলাশে হেরি লালে লাল খুন’। ২. ‘বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা যখন একই নামের সুতোয় বাঁধা’। ভাষার তৃষ্ণায় পার হয় আরো চারটি বছর। এর মধ্যে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য গান ও কবিতা তৈরি হয়। সবার হৃদয়ে তখন ভাষার আবেদনের উন্মাতাল ডামাডোল চলছে।

এরপর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮), দিনটির কথা আর নতুন করে অন্তত বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় না। ২১ ফেব্রুয়ারির নৃশংস ঘটনায় গর্জে উঠে ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হকের (১৯২৯-২০০৯) লেখনী। তিনি লিখেন- ‘ভুলবো না ভুলবো না/ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি/ভুলবো না/লাঠি গুলি আর টিয়ার গ্যাস/মিলিটারি আর মিলিটারি/ভুলবো না। /রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই/এই দাবিতে ধর্মঘট/বরকত সালামের/খুনে লাল ঢাকার রাজপথ।’

গাজীউল হকের ছোট ভাই নিজামউল হক সঙ্গে সঙ্গে বসে যায় জ্বালাময়ী এই গীতি-কবিতায় সুরারোপ করতে। তিনি ‘দূর হাঁটো দূর হাঁটো।/ঐ দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হায়’- জনপ্রিয় এই হিন্দি গানটির সুর অনুসরণ করেছিলেন। আর সুরারোপ করে ফেলেন মুহূর্তেই। প্রতিবাদের শব্দ-বৃষ্টি যেন ঝড়ছিল গানটির চরণে চরণে। মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে ধরে যেন সংগ্রামী কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল প্রতিবাদের শব্দবৃষ্টি- ‘ভুলব না, ভুলব না, ভুলব না।’ অমর একুশের সূচনাপর্বের গান হিসেবে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক ভাষা সংগ্রামী তাদের একুশের স্মৃতিচারণামূলক রচনায় গাজীউল হকের গানটিকে একুশের প্রথম গান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৫৩-৫৫ সালে এই গানটি গেয়ে প্রভাতফেরি করা হতো। গাজীউল হকের আরো একুশের গানের চরণ- ১. ‘শহীদ তোমায় মনে পড়ে, তোমায় মনে পড়ে।/তোমার কান্না তোমার হাসি আমার চোখে ঝরে।’ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হন। সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান। লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তার মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েক দিনে তিনি সম্পূর্ণ গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একুশে নিয়ে আরো রয়েছে- ১. ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা/আমি কী ভুলিতে পারি/একুশে ফেব্রুয়ারী।’ ২. ‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা।/এত রক্তের প্রাণকল্লোল সাগরে দেবেই ধরা।’

১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাষা সংগ্রামী প্রকৌশলী মোশারফ উদ্দীন আহমেদ (১৯২০-১৯৫৬) লিখেন- ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল/ভাষা বাঁচাবার তরে/আজিকে স্মরিও তারে’। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী ও প্রথম শহীদ দিবসে প্রভাতফেরিতে গানটি গাওয়া হয়। এটি প্রভাতফেরির প্রথম গান। সুর করেন আলতাফ মাহমুদ। ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত এই ঘটনার পর গ্রামীণ গীতিকার শামসুদ্দীন আহমদ রচনা করেন একটি মর্মস্পর্শী গান যেটি পল্লীগীতির সুরে সুরারোপিত হয়। গানটিতে সুর করেন আলতাফ মাহমুদ। প্রথমে কণ্ঠ দেন রথীন্দ্রনাথ রায়। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা নিয়ে লেখা হলেও এ গানটি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। গানটি শুনলে মনে হয় চোখের সামনেই যেন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি শহীদদের আত্মদান। তখন মনে হয় শহীদের এই বলিদান বৃথা যায়নি- ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী/তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি।/মা-ও কান্দে, বাপ-ও কান্দে, কান্দে জোড়ের ভাই/বন্ধু-বান্ধব কাইন্দা কয়, হায়রে খেলার সাথী নাই/ও বাঙালী...।’

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং খ্যাতনামা গীতিকার এবং সুরকার আবদুল লতিফ (১৯২৭-২০০৫), একুশের গানের সুর তার জীবনে নিয়ে আসে বেশকিছু কালজয়ী গান। তার লেখায় উঠে আসে মাতৃভাষার জন্য এক দীর্ঘ প্রাণবন্ত গান। জারির সুরের খুব সহজ ভাষায় এই গান যেন হৃদয়ের কথা বলে। প্রত্যেকটা মানুষের মনে যেন এই গান বাজে। আবদুল লতিফের এই জারিতে বাংলার নানা ঐতিহ্য, নিসর্গ, সংস্কৃতির কথা ফুটে উঠেছে। ফলে এ জারি হয়ে উঠেছে গণমানুষের অভিব্যক্তি। ভাষা আন্দোলনের গানের এই সার্বজনীন রূপ পরে ছড়িয়ে যায় সবার মাঝে। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, বাঙালিকে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তার গান- ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।/ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়।/ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।/কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়।/এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কী অন্য কথা শোভা পায়/কও দেহি ভাই।’ তারপর একে একে লিখলেন-

১. ‘বুকের খুনে রাখলো যারা/মুখের ভাষার মান/ভোলা কী যায়রে তাদের দান?’

২. ‘আমি কেমন কইরা ভুলি/মুখের কথা কইতে গিয়া/ভাই আমার খাইছে গুলি।’

৩. ‘রফিক-শফিক বরকত নামে/বাংলা মায়ের দুরন্ত ক’টি ছেলে।/স্বদেশের মাটি রঙিন করেছে/আপন বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে।’

৪. ‘আবার এসেছে অমর একুশে/পলাশ ফোটানো দিনে,/এ দিন আমার ভায়েরা আমায় বেঁধেছে রক্তঋণে।’

উল্লিখিত সব ক’টি গানই তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে।

ফজল-এ-খোদার রচিত- ‘সালাম সালাম হাজার সালাম/সকল শহীদ স্মরণে,/আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই/তাদের স্মৃতির চরণে।।/মায়ের ভাষায় কথা বলাতে/স্বাধীন আশায় পথ চলাতে/হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ/সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান/তাদের বিজয় মরণে’ গানটিতে সুরারোপ করেন শিল্পী আবদুল জব্বার। এই গানটি আজও শ্রোতাদের হৃদয় সিক্ত করে চলেছে। শহীদ স্মরণে এ গানের আবেদন কখনো ম্লান হওয়ার নয়।

১৯৫৫ সালে রচিত কবিয়াল রমেশ শীলের লেখা একটি ভাষার গান- ‘ভাষার জন্য জীবন হারালী বাঙালী ভাইরে/রমনার মাটি রক্তে ভাসালী/বাঙালীদের বাংলা ভাষা জীবনে মরণে/মুখের ভাষা না থাকিলে জীবন রাখি কেনে/কীট পতঙ্গ পশুপাক্ষী স্বীয় ভাষায় বুলি/তার থেকে কী অধম হলাম অভাগা বাঙালী।।’ তার রচিত আরো একটি গান হলো- ‘আমি বাংলা ভালবাসি,/আমি বাংলার বাংলা আমার ওতপ্রোত মেশামেশি।’

শহরের শিক্ষিত শিল্পীদের বাইরে গ্রামগঞ্জের কবিয়াল, বাউল, গায়েনদের মনেও ভাষা আন্দোলনের শোকাবহ স্মৃতি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তারা বাংলা ভাষার মানরক্ষায় শহীদদের আত্মদানের বিষয়টি নিয়ে কবিগান, জারি, গীতিকা রচনা করেছেন। পাঞ্জুশাহ, মহীন শাহ, সিলেটের শাহ আবদুল করিম তাদের মধ্যে অন্যতম। শাহ আবদুল করিমের গান- ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে/সালাম বরকতের বুকে/গুলি চালায় বেঈমানে।’

কবি শামসুর রাহমানের লেখা একুশের একটি জনপ্রিয় গান- ‘ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে/ধু ধু বালু চরে, পাখিদের নীড়ে/তুমি আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা।/সকালে দুপুরে, গোধূলী বেলায়/শত পুষ্পের নিবিড় মেলায়/তুমি আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা।’ গানটিতে সুর দিয়েছেন খন্দকার নজরুল ইসলাম এবং গেয়েছেন রুনা লায়লা। রুনা লায়লা গাওয়া আরেকটি জনপ্রিয় ভাষা আন্দোলনের গান হলো- ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’। কবি আল মাহমুদের কথায় ও খন্দকার নুরুল আলমের সুরে শাকিলা জাফর গেয়েছেন ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’। নজরুল ইসলাম বাবুর কথা ও আলাউদ্দিন আলীর সুরে সাবিনা ইয়াসমীন গেয়েছেন ‘মায়ের শেখানো ভাষা’ এবং রফিকুল আলম গেয়েছেন ‘এক তারাতে সুর বাইন্দা’। আবদুল লতিফের কথা ও সুরে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ‘ও আমার এই বাংলা ভাষা’ গানটিও জনপ্রিয়। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা ও সমর দাসের সুরে শাকিলা জাফর গেয়েছেন ‘একুশ তুমি’ আর শাম্মী আক্তার কণ্ঠ দিয়েছেন ‘বরকত সালামের রক্ত’ গানটিতে। জাহিদুল হকের কথায় ও অজিত রায়ের সুরে শাম্মী আক্তার আরো গেয়েছেন ‘বর্ণমালায় গড়েছি বাংলাদেশ’। জসিম রায়হানের কথায় এবং অজিত রায়ের সুরে সুবীর নন্দী গেয়েছেন ‘বাউল তুমি এমন দেশের কথা বল’। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা ও সমর দাসের সুরে এন্ড্রু কিশোর গেয়েছেন ‘শহীদ মিনার ভরে গেছে ফুলে ফুলে’। এছাড়া ‘মুখে মধুর বাংলা ভাষা’; ‘ক-এর রঙের মতো বাংলা’; ‘ও আমার মুখের ভাষা’; ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’; ‘একুশ মানে, ভাষার জন্যে ওরা’; ‘এক তারায় বাংলা’; ‘একুশ এলে মনে পড়ে’ গানগুলো আমাদের হৃদয় আলোড়িত করে তুলে।

ভাষা-আন্দোলন শুধু রাজধানী বা দেশের প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। অমর একুশের মর্মান্তিক ঘটনা দেশের প্রধান কবি ও গীতিকারদের যেভাবে আলোড়িত করেছিল- একইভাবে আলোড়িত করেছিল দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আউল-বাউল, স্বভাব-কবি, গ্রামীণ বয়াতি ও কবিয়ালদের। তাদের রচনা একুশের গানকে ভিন্নমাত্রায় উন্নীত করেছে। এরা শুধু গান রচনা করেই থেমে থাকেনি, গ্রামেগঞ্জে, হাটবাজারে গেয়ে বেড়িয়েছেন। একুশের গান গাওয়ার জন্য এদের অনেকেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। মাতৃভাষা, ভাষা আন্দোলন ও শহীদ দিবস স্মরণে গত অর্ধশতকে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গান। নিচে আরো কিছু গান-‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা/জ্বলছে স্মৃতি আলোর বুকে ভোরের করুণ তারা’ (বদরুল হাসান); ‘শহীদি খুন ডাক দিয়েছে/আজকে ঘুমের ঘোরে/আজ রক্তপথের যাত্রী মোরা/নতুন আলোর ভোরে’; ‘রিক্ত শপথে আজিকে তোমারে স্মরণ করি/একুশে ফেব্রুয়ারী’ (তোফাজ্জল হোসেন); আমাদের চেতনার সৈকতে/একুশের ঢেউ মাথা কুটলো/শহীদের রক্তের বিনিময়ে/চোখে জল কয় ফোঁটা জুটলো’ (নাজিম মাহমুদ); ‘মিলিত প্রাণের কলরবে/যৌবন ফুল ফোটে রক্তের অনুভবে’ (হাসান হাফিজুর রহমান); ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে/সেদিন বর্ণমালা/সেই থেকে শুরু দিনবদলের পালা’ (আবু হেনা মোস্তফা কামাল); ‘একঝাঁক পলাশের দুরন্ত রক্তে/রাজপথ জনপথ সিক্ত/শহীদের শপথেরা হৃদয়ের স্তম্ভে/দুর্জয় উন্মেষে দীপ্ত’ (ইন্দু সাহা); ‘ভুলব না কোনো দিন ফাল্গুনের ইতিহাস;/ভুলব না খুন রাঙা এই দিন এই মাস।/ফাল্গুনের ইতিহাস ভুলব না’ (সিরাজুল ইসলাম); ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা এমন ভাষা আর যে নাই/এ ভাষাতে মা-কে ডাকি ডেকেছে মোর সালাম ভাই।’ (মোহাম্মদ মাতু মিয়া); ‘সালাম আমার শহীদ স্মরণে/দেশের দাবি নিয়া দেশপ্রেমে মজিয়া/প্রাণ দিলেন যেসব বীর সন্তানে’ (শাহ্ আবদুল করিম); ‘বাংলাদেশের মানুষ, ফেব্রুয়ারী একুশে ভুলিতে পারবে না জীবনে/ভাষা আন্দোলনের জন্য জনসমাজ হল বিপণন কুখ্যাত সরকারের শাসনে।’ (বিজয় সরকার); ‘শোন দেশের ভাই-ভগিনী/শোন আচানক কাহিনী/কান্দে বাংলা জননী ঢাকার শহরে’; ‘কাইন্দ না মা কাইন্দ না আর বঙ্গজননী/তুমি যে বীর প্রসবিনী গো তুমি শহীদ জননী।’ (হেমাঙ্গ বিশ্বাস); ‘বাঙালিদের বাংলা ভাষার রাখি ইজ্জত মান/হাসিমুখে শফিক বরকত করে জীবন দান।’ (কবিয়াল ফণী বড়–য়া); ‘এদিক-ওদিক বলতে আমার অনেক হবে দেরি/মন দিয়া শোনেন ভাষা আন্দোলনের জারী...।’ (আবদুল হালিম বয়াতি); ‘একুশ তুমি’ (মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান); ‘বর্ণমালায় গড়েছি বাংলাদেশ’ (জাহিদুল হক)।

একুশের প্রথম তিনটি সংকলনে-প্রমথ নন্দী সম্পাদিত ওরা প্রাণ দিল (সেপ্টেম্বর ১৯৫২), হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি (মার্চ ১৯৫৩) এবং ডি এ রশীদ ও মহিউদ্দীন আহমদ সম্পাদিত একুশের সংকলন (১৯৫৬)-এ একুশের গানের স্বল্পতা রয়েছে। কারণ সংকলনগুলো প্রকাশের সময়েই একুশের বিখ্যাত বেশ কয়েকটি গান রচিত হয়েছিল। প্রথম সংকলনটিতে দুটি, দ্বিতীয়টির প্রথম মুদ্রণে দুটি ও তৃতীয়টিতে মাত্র একটি গান সংকলিত হয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমানের একুশে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সংস্করণে জসীমউদ্দিন ও আবদুল লতিফের একটি করে এবং তৃতীয় সংস্করণে ইন্দু সাহার একটি গান যুক্ত হয়। এ ধারাটি একুশে ফেব্রুয়ারির চতুর্থ সংস্করণে আর অব্যাহত থাকেনি।

এছাড়াও একুশের গানের কবি ও গীতিকারদের মধ্যে রয়েছেন- সত্যেন সেন, জসীমউদ্দিন, আলিমুজ্জামান চৌধুরী, আল মাহমুদ, সিকান্দার আবু জাফর, কাজী লতিফা হক, নরেন বিশ্বাস, দিলওয়ার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মহিন শাহ, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, আবিদ আনোয়ার, বদরুল হাসান, জাহিদুল হক, নাসির আহমেদ, মতলুব আলী, শাফাত খৈয়াম, মুহাম্মদ মুজাক্কের, এস এম হেদায়েত, আজাদ রহমান, নজরুল ইসলাম বাবু, আবুবকর সিদ্দিক, সৈয়দ শামসুল হুদা, ফজল-এ-খোদা, হামিদুল ইসলাম, মুন্সী ওয়াদুদ, হাবীবুর রহমান, আসাদ চৌধুরী, জেব-উন্-নেসা জামাল, মাসুদ করিম, আজিজুর রহমান, আজিজুর রহমান আজিজ, কে জি মোস্তফা, আবদুল হাই আল হাদী, নুরুজ্জামান শেখ, জসিম রায়হান প্রমুখ।

একুশের গানে সুরারোপ করেছেন আলতাফ মাহমুদ, আবদুল লতিফ, মোমিনুল হক, নিজামউল হক, সমর দাস, সত্য সাহা, সাধন সরকার, আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, শেখ লুৎফর রহমান, খোন্দকার নূরুল আলম, অজিত রায়, লোকমান হোসেন ফকির, আবদুল জব্বার, খান আতাউর রহমান, প্রশান্ত ইন্দু, রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কবিয়াল ফণী বড়–য়া, আবেদ হোসেন খান, দেবু ভট্টাচার্য, বশির আহমেদ, রাম গোপাল মোহান্ত, সুখেন্দু চক্রবর্তী, হরলাল রায়, আলাউদ্দীন আলী প্রমুখ।

চন্দ্রাহত সৌন্দর্যের এলোকেশী বিথীকায় বাঙালি সংস্কৃতির পূর্ণ প্রতিচ্ছবি বিন্যস্ত হয়েছে একুশের বৃন্ত থেকে প্রস্ফুটিত আলো ঝলমলে এক সোনালি সকালে। সেই সকালের শিশিরমাখা দুয়ারে দাঁড়িয়ে একুশের কবি, গীতিকার ও সুরকারদের নামের এই বিশাল তালিকা আমার এই স্বল্প জ্ঞানে অল্প লেখায় হয়তো সম্পন্ন করা সহজসাধ্য নয়। তবে এ কথা বলতে পারি লেখার সংখ্যা নয় তাদের প্রত্যেকের লেখনী বাঙালিকে দেশমাতৃকার ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ করেছে বলেই এ ভূখণ্ডে বাঙালির যা কিছু অর্জন তার পুরোটারই পশ্চাৎভূমি হিসেবে রয়েছে অমর একুশের অনন্য ভূমিকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close