নাসের মাহমুদ

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

ভাষা আন্দোলন : বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশকাল

সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা উর্দুকে সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে একমাত্র প্রাধান্য দিয়ে বাংলা ভাষার অধিকারকে হরণ করে। পরে অভিজাত শাসকরা আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করলে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত তীব্র ঘৃণা ভরে তা প্রত্যাখ্যান করে। আর এর মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিম প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মধ্যবিত্ত হিসেবে নিজের উত্তরণ ঘটায়। কাজেই ভাষা আন্দোলন বাঙালি মুসলমানকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী করে গড়ে তোলে ও স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ অনুধাবনের সক্ষমতা প্রদান করে।

বাঙালি জাতির প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ও উদ্দীপ্ত প্রেরণার নাম ভাষা আন্দোলন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্তির পর বাঙালি মুসলিম সমাজের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যের সূচনা হয়, বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানে অস্বীকার করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আমাদের অহংকার ও গর্ভের বিষয় মাতৃভাষার অধিকারের প্রশ্নে বাঙালি অতি দ্রুত সংঘটিত হয়ে তাৎক্ষণিক এবং যথোপযুক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী, তরুণ রাজনীতিবিদ এবং ছাত্র সমাজের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। বাঙালি মুসলমানের মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি যে নাড়ির টান, তার শক্তি সম্পর্কে অনুধাবনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের চশমাপরা মুসলিম লীগের শাসকরা। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে’ কলকাতা দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ও মুসলমানদের রক্ষায় এবং পরে সিলেট গণভোটে সিলেটকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে সংগঠক ও প্রচারক হিসেবে কাজ করা তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব অন্য ছাত্রদের সঙ্গে কার্জন হলে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার প্রতিবাদে নো নো ধ্বনিতে ফেটে পড়েন। এই ছানিপড়া ও একচোখা মুসলিম লীগ দিয়ে যে বাঙালি জাতির অধিকার আদায় ও মুক্তি সম্ভব নয় তা প্রথম উপলব্ধি করেন সদ্য কলকাতা হতে ফিরে আসা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক তৎকালীন ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

চৌধুরী রহমান আলী ‘নাউ অর নেভার’ নামক পুস্তকে ১৯৩৩ সালে প্রথম ব্যবহৃত ‘পাকিস্তান’ শব্দটিতে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় পাঁচটি প্রশাসনিক ইউনিটে ৩০ মিলিয়ন মুসলিমের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি করেন। ‘পাকিস্তান (চধশরংঃধহ)’ শব্দটি ইংরেজি পি-পাঞ্জাব, এ-আফগান প্রদেশ (বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে আফগান), কে-কাশ্মীর, আই-ইন্দাস (সিন্দু প্রদেশ) নিয়ে গঠিত। ধর্মীয় বিবেচনায় পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব হলেও তাতে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি মুসলিম প্রধান বাংলা প্রদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পরে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাবে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একাধিক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের দাবি পেশ করেন ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ। লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম প্রধান উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো নিয়ে একটি ও পূর্বাঞ্চলীয়তা মুসলিম প্রধান আসাম ও বাংলা নিয়ে আরেকটি স্বাধীন দেশ গঠনের দাবি করেছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান দেশ ভাগের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মূলত শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও শরৎ বসুর প্রস্তাবিত আসাম বাংলা প্রদেশ নিয়ে স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায়।

মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৭ সালের দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে উর্দু প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বিরোধিতায় তা সফল হয়নি। পরে ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মুসলিম লীগের আরেক নেতা চৌধুরী খলিকুজ্জামান এবং আলীগড় বিশ^বিদ্যালয় উপাচার্য ড. জিয়া উদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণের প্রস্তাব করেন। বাংলার মনীষী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ কয়েকজন বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করে বাংলার পক্ষে বক্তব্য দেন। ভারত বিভাগের পূর্বের ভাষার প্রশ্নে বিতর্ক দেখা দেয়। মুসলমানের জন্য পৃথক বাসভূমির লড়াই অবাঙালি মুসলিম নেতাদের সঙ্গে একত্রে করলেও ভাষার প্রশ্নে পূর্ব বাংলার মুসলমান নিজস্ব বাঙালি চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে। দেশ বিভাগের পরে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকা বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের জাগরণে শরিক হতে না পারা পূর্ব বাংলার মুসলমান বাঙালি সত্তায় উদ্দীপ্ত হয়ে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ পাস হলে বাঙালি মুসলমান কৃষক প্রথমবারের মতো রায়তী দখলকার হতে জমির মালিকানাপ্রাপ্ত হয়। ফলে সত্যিকার অর্থে আইন বলে বাঙালি মুসলমানের মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তরণ ঘটে। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন উঠলে বাঙালি যুব সমাজ ‘মাছে ভাতে বাঙালি ও গলার স্বরে বাংলা’ এই মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষার দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হক বলেন, ‘প্রস্তাবগুলো পাঠ করে তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করার দাবি পেশ করেন।’ পূর্ব বাংলায় বাঙালি মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়নের প্রথম সংগঠন হিসেবে শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালি মধ্যবিত্ত ছাত্রদের প্রাণের সংগঠন ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির অন্যতম ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব। মূলত বাঙালি শিক্ষিত মুসলমানের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে বাঙালি মধ্যবিত্ত তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সূচনা করে। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষিত প্রতিনিধি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে। ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাঙালি মধ্যবিত্তের জাগরণের অন্যতম সংগঠন যা ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নুরুল হক ভুঁইয়াকে আহ্বান করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। বাঙালি মুসলমান নতুন রাষ্ট্র পেলেও সরকারি সব ফরম, মানি অর্ডার, ডাকটিকিট, দলিল, আদালতের রায় উর্দু এবং ইংরেজি ভাষায় লেখা থাকায় পরাধীন ভাব হতে তার মুক্তি মেলে না। জমি বিক্রি করতে গেলে, দলিল লিখতে হচ্ছে দুর্ভেদ্য উর্দু ভাষায় যা বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের গলায় কাঁটা হয়ে আটকে রয়। পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস দলীয় বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি তোলেন। কিন্তু তা নাকচ হয়ে যায় মুসলিম লীগ সদ্যসদের কণ্ঠ ভোটে। প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ ২৫ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে। অর্থাৎ ভাষার দাবিতেই বাঙালি মধ্যবিত্ত প্রথমবার রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ মধ্যবিত্ত ছাত্র সমাজ শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করে। ১১ মার্চের হরতালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেকে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেপ্তার হন। ভাষা ষড়যন্ত্রকারীদের বিরোধী আন্দোলন সারা বাংলার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে সম্বিত ফিরিয়ে দিয়ে জানান দেয় ৩০০০ কিমি ব্যবধানে ধর্মীয় বন্ধনে গঠিত রাষ্ট্র কতটা ঠুনকো, বৈষম্যমূলক এবং হঠকারী। বাঙালি মুসলিম এই প্রথম অনুভব করে নিজ দেশে পরবাসী হওয়ার জ¦ালা। সেই জ¦ালা মেটাতে ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালির তরুণ নেতা মুজিবসহ মধ্যবিত্তের শিক্ষিত অংশ। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি অধিকার আদায়ের দীক্ষা পায় ভাষা আন্দোলন হতে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ সব বড় শহর হয়ে মফস্বল শহরে। আন্দোলনের ঢেউ আচড়ে পড়ে গ্রামেগঞ্জে, হাটে-বাজারে। ধর্মীয় বাতাবরণ খুলে পড়ে। বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ আত্মোপলব্ধি করে বাঙালি চেতনায় জাগরিত হতে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও পূর্ববাংলার মুসলিম লীগ নেতারা তাদের কৌলিন্য বা আভিজাত্যের নগ্ন আগ্রাসন হিসেবে মাত্র ৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা উর্দুকে ৫৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দিতেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করে। মুখের ভাষা সরকারি কাজে ব্যবহার করতে পারার স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপকারী এই উর্দু ভাষার আগ্রাসন, বাঙালি মধ্যবিত্তকে খাঁচায় বন্দি পাখির মতো অপরিচিত বুলি আত্মস্থ করাতে বাধ্য করে। ফলে দেশ বিভাগের পর প্রথম বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত ভাষার আগ্রাসনের প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, যা বাঙালি মুসলমানের অন্তর্জগতের পরিবর্তন ঘটিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্ত হতে বাঙালি মধ্যবিত্তে উত্তরণ ঘটায়। এই রূপান্তর শিক্ষিত ছাত্র সমাজের তরুণ নেতারা বিশেষত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিব দারুণভাবে উপলব্ধি করেন এবং রূপান্তরিত বাঙালি মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনতে ভাষার দাবির প্রতি তার লড়াই ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ’৫২ সালের পরও অব্যবহৃত রাখেন। ভাষা আন্দোলন, কুলিন মুসলিম লীগ শাসকদের অভিজাত্যের ভাষাকেন্দ্রিক বহিঃপ্রকাশের বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। অভিজাত শ্রেণি ভাষার অগ্রাধিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বদা আমজনতার মুখের ভাষাকে অস্বীকার করে। এটা এখনো বর্তমান উচ্চবিত্তের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিপদ ঘটে তখন, যখন রাষ্ট্রের যোগাযোগের মাধ্যমরূপে অভিজাত শ্রেণির ভাষাকে একমাত্র প্রাধান্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে যখন বঞ্চিত করা হয় এবং পাকিস্তান সরকার ঠিক তাই করেছিল। সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা উর্দুকে সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে একমাত্র প্রাধান্য দিয়ে বাংলা ভাষার অধিকারকে হরণ করে। পরে অভিজাত শাসকরা আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করলে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত তীব্র ঘৃণা ভরে তা প্রত্যাখ্যান করে। আর এর মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিম প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মধ্যবিত্ত হিসেবে নিজের উত্তরণ ঘটায়। কাজেই ভাষা আন্দোলন বাঙালি মুসলমানকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ^াসী করে গড়ে তোলে ও স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ অনুধাবনের সক্ষমতা প্রদান করে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত সাহিত্য, কবিতা, গান, একুশের সংকলন বাঙালি মধ্যবিত্তের শিক্ষিত অংশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অধিকার সচেতন হিসেবে গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে দেশজুড়ে চালু হওয়া প্রভাতফেরি এবং মফস্বল শহরেও প্রভাতফেরিতে নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ, বাঙালি মধ্যবিত্ত অভিভাবকের মানসিক অগ্রগামিতাকে নিদর্শন করে। এই মানসিক প্রগতিশীল পরিপক্বতাও ভাষা আন্দোলনের আরেক ফসল। আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লিখিত সাহিত্য, বিশেষত মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাষার রক্ত রাঙানো’ গান, জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশের সংকলন’, শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ইত্যাদি আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ, দুপুর বেলার অক্ত, বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি কোথায়, বরকতেরই রক্ত’- আল মাহমুদের ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছে হয়, ভাষা আন্দোলনে বাঙালি কেবল আন্দোলনেই ফেটে পড়েনি, বাঙালি মধ্যবিত্তের মুসলিম মানসিক চেতনায় বাঙালি জাতিয়তাবাদের উত্তরণ এবং অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন জাতিসত্তার ভিত গড়তে ভাষা আন্দোলন বাঙালির রেনেসাঁ হিসেবে কাজ করেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close