ডা. এস এ মালেক
ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা
বছর ঘুরে আবার এলো ফেব্রুয়ারি। বায়ান্নর রক্তঝরা দিনগুলো। আসলে ভাষা আন্দোলন ছিল একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এটা ছিল বাংলা ভাষার ওপর পাকিস্তানি শাসকবর্গের পুরোপুরি আগ্রাসন। তারা ভেবেছিল উর্দুকে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে পারলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হবে। বাঙালিকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় উদ্বুদ্ধ করা যাবে। এ কারণে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন- ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে।
তার এই ভাষণে তাৎক্ষণিকভাবে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ নো নো নো ধ্বনি তুলে প্রতিবাদ জানায়। শুরু হয় আন্দোলন এবং আন্দোলন একটা পর্যায়ে এমন প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে যে, সরকার সে আন্দোলন দমন করার জন্য গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। প্রাণ বিসর্জিত হয় বেশ কয়েক জন যুবকের। সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউলসহ শহীদ হন অনেকেই। তাদের বুকের তাজা রক্ত বৃথা যায়নি।
পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে ওই আন্দোলন যে শুধু একটা ভাষাভিত্তিক আন্দোলন ছিল তা নয় বরং স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি তখন উঠেছিল, সেই আন্দোলনের পরিপূরক ছিল ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের গণজাগরণ দেখে শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নেন; এ আন্দোলনকে একটা পূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তর করতে। যারা বলেন শেখ মুজির তো জেলে ছিলেন। তাই তার আন্দোলন করার সুযোগ ছিল না।
তাদের বলতে হয়, শেখ মুজিব তো ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করার পরই বাংলা ভাষার দাবি তোলেন। পাকিস্তান পার্লামেন্টের একজন সদস্য হিসেবে তিনি বারবার স্পিকারকে এই বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেন। পাকিস্তানের সাংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষাকে অবহেলা করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছিল না। তারা ভেবেছিল, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালি এমনিতেই ৫০ বছর পিছিয়ে যাবে।
রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের দখলে থাকায় এই ৫০ বছর তারা বাংলাদেশ ও বাঙালিকে শোষণ করতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সঠিকভাবে উপলব্ধি করছেন, ভাষা আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের সংযুক্তি ঘটিয়ে এমন কঠোর আন্দোলন আয়োজন সম্ভব, যার জবাব পাকিস্তান দিতে সক্ষম হবে না। তাই ভাষা আন্দোলনের গণজাগরণকে তিনি মূলত স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে রূপান্তর করলেন।
লাহোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন তার ঐতিহাসিক ৬ দফা। স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব থেকেই উঠেছিল। শেখ মুজিবের কৃতিত্ব হচ্ছে- ওই দাবির তিনি পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেন। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া যবে না। এটাই ছিল ৬ দফার মূল কথা। আনুষঙ্গিক অন্যান্য দাবিও ছিল ৬ দফায়। কিন্তু মূল বক্তব্য ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ পাচার নিষিদ্ধ করা।
পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করতে যা যা করা দরকার তাই করা। ৬ দফা ঘোষণার পর পাকিস্তানিদের ১ নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে শেখ মুজিবকে। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান জানালেন, তিনি অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার জবাব দেবেন। শেখ মুজিব আইয়ুবের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে তার ৬ দফা আন্দোলন শুরু করেন ও ৬ দফাভিত্তিক দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন।
গণঅভ্যুত্থানে সাড়া পেয়ে লাখ জনতার মাঝে তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধি পান। তারপর তিনি বাধ্য করেন সামরিক সরকারকে নির্বাচন দিতে। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয় অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ। পূর্ব বাংলার ১৬৮টি আসনের ভেতর ১৬৬ আসন পায় দলটি। তাই বিজয় এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন, তার ৬ দফাকে জনগণ গ্রহণ করেছে। তখন তিনি ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানান। কেন্দ্রীয় সরকার তা অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন।
প্রত্যুত্তরে শেখ মুজিব তার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। মাত্র ৩ সপ্তাহের আন্দোলনে কেন্দ্রীয় সরকার অচল হয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলার জনগণ শেখ মুজিবের কথা মতো দেশ পরিচালনা শুরু করেন। কার্যত শেখ মুজিবকেই বাংলার নির্বাচিত শাসক হিসেবে জনগণ মেনে নেন। এরপর শুরু হয় ২৫ মার্চ কালরাত। এক রাতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ নিহত হয়। চলল ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
সেই থেকে আমরা স্বাধীন। ৯ মাস যে যুদ্ধ হয় তা ছিল দখলদারদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাতের যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তা সম্ভব হয়। সে কারণেই ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২৬ মার্চ হচ্ছে- স্বাধীনতা ঘোষণার দিন। এভাবে ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তর করে শেখ মুজিব স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করে তোলেন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্বীকৃতি পাওয়ার পর যদি ওই আন্দোলন থেমে যেত তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্ভব হতো না। শেখ মুজিবের দূরদর্শিতাই স্বাধীনতা অর্জনের মূল কারণ। তার ৬ দফা যে ১ দফার আন্দোলন ছিল তা বুঝতে কারো বাকি ছিল না। শেখ মুজিব বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বিশ্বকে অবহিত করেন, বাঙালি পাকিস্তানের শাসন মানে না। তার জন্য দরকার ছিল স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ইতিহাসের কালজয়ী ভাষণে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি তার সেই ভাষণকে সফল ও সার্থক করে তুলেছেন। আমরা বাঙালি আজ বাংলা ভাষায় কথা বলি। ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে শেখ মুজিবের অবদান অবিস্মরণীয়। শেখ মুজিব ছিলেন মনে প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি।
বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন। তাই তার মৃত্যুর পরও তিনি জনগণের কাছে সমাদৃত। তিনি চিরঞ্জীব। খুনিরা তাকে হত্যা করেছে ঠিকই কিন্তু তিনি তার আদর্শের মাধ্যমে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন চিরকাল। যাদের আত্মত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে অমর ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে, সেসব ভাষাশহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
"