শোভন আহমেদ, ভেড়ামারা (কুষ্টিয়া)

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫

গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প

খাল পানিশূন্য, বোরো আবাদ নিয়ে শঙ্কা

দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের খালে এবারও পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই অনিশ্চয়তায় পড়েছে এই মৌসুমের বোরো চাষাবাদ। পদ্মা নদীতে বড় আকারের চর পড়া ও পানির স্তর নেমে যাওয়াকেই প্রধান কারণ হিসেবে দুষছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। 

গত ১৫ জানুয়ারি সেচ প্রকল্পের আওতায় থাকা সব খালে পানি আসার কথা ছিল। কিন্তু জানুয়ারি শেষ হয়ে গেলেও পানির দেখা মেলেনি। 

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বোরো মৌসুমে গম, সরিষা, ভুট্টাসহ অন্যান্য  চাষাবাদ শুরু হয়েছে ১৫ অক্টোবর থেকে। ধান রোপণ কার্যক্রম চলছে। কিন্তু পানি না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে কৃষকরা। চলতি বোরো মৌসুমে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে তাদের মাঝে। 

কৃষকদের দাবি, জি-কে সেচখালের পানি দিয়ে চাষাবাদ  করতে খরচ হয় বিঘাপতি মাত্র ৩০০ টাকা। অন্যদিকে ডিজেল চালিত স্যালো ইঞ্জিন দিয়ে চাষাবাদে খরচ ১০-১২ হাজার টাকা। এত বিপুল পরিমাণ খরচের কারণে অনেক জমি তাই অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে  উৎপাদিত ফসলের মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচই বেশি পড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কৃষকরা। যার ফলে  অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে লাখ লাখ কৃষক।

ভুক্তভোগী কৃষক আসাদুর রহমান বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরেই এমন অবস্থা বিরাজ করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন পদ্মা নদীর  চরে ডেইজিং  করছে। কিন্তু এটা অনেক আগে থেকেই শুরু করা উচিত ছিল। স্যালো মেশিন দিয়ে পানি তুলে চাষাবাদ করলে লাভের চেয়ে লোকসানের ভাগই বেশি চলে যায়। এই অঞ্চলের কৃষকরা খুবই অসহায়। শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়ায় দুষ্কর হয়ে যায়।কৃষকদের সেচ কার্য  সমাধানে কৃষি অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একসাথে কাজ করা উচিত।

চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, গত বছরও জিকে খাল থেকে আমরা পানি পাইনি। এ বছর আমার ১৫ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। ডিজেল ইঞ্জিনের মাধ্যমে যে পানি পাওয়া যায় সেটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। 

চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের আরেক কৃষক এনামুল মেম্বার (ইউপি সদস্য) বলেন, খালে পানি থাকলে বিঘাপতি খরচ ৩০০ টাকা।স্যালো  ইঞ্জিনের মাধ্যমে চাষ করলে  বিঘাপতির খরচ ১০- ১২ হাজার টাকা। জিকে খালে পানি না থাকলে গভীর নলকূপে পানি থাকে না। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় শুকনো মৌসুমে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৪ জেলার ১৩টি উপজেলার প্রায় পৌনে ৫ লাখ একর জমি। এই সেচ প্রকল্পের পানির উপর নির্ভরশীল কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা এই ৪ জেলার ১৩টি উপজেলার কয়েক লাখ কৃষক। ৩টি পাম্পের মধ্যে ২টি পাম্প গত কয়েক বছর আগে থেকেই অচল হয়ে গেছে। পানির দুষ্প্রাপ্যতা আর লেয়ার নিচে নেমে যাওয়া আর পদ্মা নদীতে চর পড়ে গভীরতা কমে যাওয়ায় অপরটিও বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) । 

পাম্প হাউস সূত্রে আরো জানা গেছে, ১৯৫১ সালে প্রাথমিক জরিপের পর ১৯৫৪ সালে জি-কে সেচ প্রকল্প অনুমোদন পায়। ১৯৫৯ সালে প্রধান পাম্প হাউজের কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৬২-৬৩ সালে প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে জিকে সেচ প্রকল্প চালু করা হয়।তখন চাষযোগ্য ফসলি জমি ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ হেক্টর। পরবর্তীতে পাম্পের ক্যাপাসিটি কমার সাথে সাথে জমির পরিমাণ কমে দাড়ায় ৯৫ হাজার ৬১৬ হেক্টর। শুরুতে তিনটি পাম্প দিয়ে বছরে ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আক্টোবর পর্যন্ত) দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা পানি উত্তোলন করা যেত। বাকি ২ মাস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাম্প তিনটি বন্ধ রাখা হত। ৩টি পাম্প সচল থাকলে ৪ জেলার ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়। আর সেচ প্রকল্পের প্রধান এবং শাখা খালগুলোতে পানি থাকলে এখান থেকে কৃষকরা নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা পান। ৩টি পাম্প একসঙ্গে চালু থাকলে প্রতি সেকেন্ডে ৩ হাজার ৯০০ কিউসেক পানি আবাদি জমিতে দেওয়া সম্ভব হয়। এছাড়া বিকল্প হিসেবে আরও ১২টি ছোট পাম্প ছিল। সেগুলোও বিকল হয়ে গেছে। উপর্যুপরি  কয়েক বছর আগে ২টি পাম্প সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়।এর সাথে সাথে ক্যানাল গুলোর পানি ধারণ ক্ষমতাও কমে গেছে। কোথাও কোথাও এর শাখা খাল গুলো মরে গেছে বলেও জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা।

ভেড়ামারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা সুলতানা বলেন, জিকে প্রজেক্টের আওতায়  ভেড়ামারার দুটি ইউনিয়ন চাঁদগ্রাম ও বাহিরচরের বিস্তীর্ণ  ফসলি জমি পড়েছে। যার পরিমাণ ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর। এরমধ্যে বোরো ধানের আবাদ ৬৩৫ হেক্টর, সরিষা আবাদ ১১৯ হেক্টর বাদবাকি ভুট্টা, গমসহ অন্যান্য। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কৃষকদের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছি।অনেককেই বিএডিসি সেচ প্রকল্পে আওতায় এনেছি। 

ভেড়ামারার জি-কে পাম্প হাউজের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর ১০ মাস এই সেচ প্রকল্পের কাজ চলে। এটি মূলত পদ্মা নদীর পানি দিয়ে পরিচালিত হয়। বর্তমানে নদীর পানির লেভেল ৫ দশমিক ৫ মিটার। ৪ দশমিক ৫ মিটারের নিচে সেচ কার্যক্রম সম্ভব নয়। তাছাড়া নদীতে বড় আকারের চর পড়েছে। আমরা ডেইজিং এর কাজ চলমান রেখেছি। পানির লেভেল যদি ঠিক থাকে এবং নদীর ডেইজিং এর কাজ সুসম্পন্ন হলে, আশা করি ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেচ প্রকল্প শুরু করতে পারব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close