মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)
সরকারি স্কুলে অসন্তোষ, কিন্ডার গার্টেনে ঝুঁকছেন অভিভাবকরা

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নানা রকম সুযোগ সুবিধাসহ অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং বিনা বেতনে শিশুদের লেখাপড়া করানোর সুযোগ থাকলেও বর্তমানে কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষার প্রতি অভিভাবকের আস্থা ও ভরসা বেশি। যার ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দিনদিন ছাত্রছাত্রী সংখ্যা তুলনামূলক কমতে শুরু করেছে।
যশোরের বেনাপোল পৌরসভা এবং ইউনিয়নের প্রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংকট বাড়ছে দিনকে দিন। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের এখন কিন্ডারগার্টেনমুখী শিক্ষার দিকে বেশি অগ্রসর হচ্ছেন। এর কারণ হিসাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকেরা। সরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার মানবৃদ্ধির লক্ষে তদারকির দাবিসহ শিক্ষকদের আরো বেশি আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
শার্শা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা গেছে, বেনাপোল পৌরসভায় ও ইউনিয়নে ১৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। সেই সঙ্গে কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় ২৭টির অধিক। যার ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক গুণ বেশি।
দেখা যায়, বেনাপোলের কাগজপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম। অন্য শ্রেণিগুলোতে শিক্ষার্থীদের আসন ফাঁকা ছিল। এ সময় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী না থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন স্কুলে খেলাধুলা চলায় এবং সবাই বই বিতরণ করতে না পারায় বিদ্যালয়ে উপস্থিতি একটু কম। যদিও দিনের হাজিরা খাতা অনুসন্ধানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি পাওয়া যায় আশানুরূপ। একই ধরনের অবস্থা দেখা গেছে, নারায়নপুর নতুনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। খবর নিয়ে দেখা যায়, এ বিদ্যালয়ে নতুন ভর্তিসহ এখন পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী সংখ্যা মাত্র ৯৪ জন।
এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষিক দ্বিন মোহাম্মদ বলেন, আমাদের বিদ্যালয়টি ছোট একটা গ্রামের মধ্যে। এখানে এমনিতেই ছাত্রছাত্রী কম তার ওপরে আছে কিন্ডারগার্টেনের চাপ। এখন আরো নতুনভাবে চাপ তৈরি করছে ইসলামি কিন্ডারগার্টেনগুলো। এখানে দ্বীনি শিক্ষার সঙ্গে ক্যাডেট চালু হওয়ায় অভিভাবকেরা এ শিক্ষার দিকে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। এসব ইসলামি কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের পরবর্তী ভবিষ্যৎ কি সেটা নিয়ে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাদের ভাবনার বিষয় রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, অনেক ছাত্র বিদ্যালয়ে আসে না। তারা কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। শুধু শিক্ষা উপবৃত্তির জন্য ভর্তি হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে। কারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উপস্থিতি না থাকলেও নিয়মিত উপবৃত্তি তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। তবে এসকল বিষয় এখন আর কোথাও চালু নেই বলে অস্বীকার করেছেন সবাই।
জানা গেছে, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ উপেক্ষা করে অভিভাবকরা শিক্ষা বাণিজ্যের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। কারণ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেনগুলো শিক্ষার্থী ধরতে চালানো হয় নানা প্রচার প্রচারণা। এ ক্ষেত্রে চাকচিক্যই তাদের মূল কথা।
তবে ভিন্ন কথা বলছেন শিক্ষার্থী অভিভাবকরা। তাদের মতে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় তদারকির অভাব রয়েছে। এর বিপরীতে কিন্ডারগার্টেনে তদারকি ও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। আছে জবাবদিহিতার সুযোগ, সেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছে অজুহাতের পাহাড়।
সাইবুর রহমান নামের এক অভিভাবক জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভবন আছে, খেলার মাঠ আছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকও আছেন। কিন্তু পড়ালেখার মানের প্রশ্নে অভিভাবকদের সন্তুষ্টির অভাব আছে। তাছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত ও যথাসময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন না। ক্লাসে পাঠদানের বিষয়ে আন্তরিক নন শিক্ষক শিক্ষিকারা। এসব কারণে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে আগ্রহ বাড়ছে।
বেনাপোলের নামকরা সানরাইজ কিন্ডারগার্টেনের কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থীর মা সোনিয়া খাতুন বলেন, কিন্ডারগার্টেনে স্কুলগুলোতে যেভাবে যত্ন নিয়ে পড়ানো হয়, প্রাথমিকে বিদ্যালয়ে তা হয় না।
তবে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইজ্জত আলী দাবি করেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানের ওপর ব্যাপক তদারকি রয়েছে। শিক্ষা প্রশাসন এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করায় সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থারও উন্নতি হচ্ছে। বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, তিনি শিক্ষা ও বিদ্যালয়ের সৌন্দর্য উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন।
বেনাপোল বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়টি সাজানো গোছানো এবং পরিপাটি। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শৌচাগার পর্যন্ত ঝকঝক করছে। বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলও ভালো। তারপরও কেন বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী বাড়ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে সহকারী শিক্ষক আলাউদ্দিন বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলে অভিভাবকদের বেশি আগ্রহ দেখানোর কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন সময়সূচিকে। তার মতে, কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের ক্লাস টাইম দুই ঘণ্টা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে চার ঘণ্টা থেকে ছয় ঘণ্টার অধিক। যেটা শিশুদের জন্য কষ্টদায়ক এবং বেশিরভাগ সচেতন অভিভাবক এটা পছন্দ করেন না।
জানা যায়, গত বছর কাগজপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ৩৩৭। বর্তমানে এক বছরের ব্যবধানেও এ বিদ্যালয়টিতে নতুন শিক্ষার্থী বাড়েনি। অথচ বিদ্যালয় এলাকার ওইসব কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির সংখ্যা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কাগজপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শাহানাজ পারভিন বলেন, আমরা বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কিন্ডারগার্টেনমুখী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে বেশিরভাগ অভিভাবকই মনে করেন তাদের সন্তান কিন্ডারগার্টেনে না পড়লে তারা সমাজে সম্মানের সহিত পরিচয় দিতে পারবে না।
এ বিষয়ে শার্শা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ওয়ালিউর রহমান বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আমরা প্রতিমাসেই পরিদর্শনে যাচ্ছি। তার পরও কিন্ডারগার্টেনের সঙ্গে অঘোষিত প্রতিযোগিতায় থাকতেই হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক উন্নত হচ্ছে, বাচ্চাদের বইয়ের চাপ কম, যদিও সময় একটু বেশি নিয়ে পড়ানো হয় তবে সামনের দিনে স্কুলেই বাচ্চাদের টিফিনের ব্যবস্থা করা হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো অভিভাবকদের খুশি করতে বাচ্চাদের রেজাল্ট দেখায় বেশিরভাগই ১০০ তে ১০০। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের নানা প্রলোভন চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন, সমাজে স্ট্যাটাস মেইনটেইনসহ ইত্যাদি কারণে অভিভাবকেরা এদিকে ঝুঁকছেন। তবে কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালনার বিষয়ে সরকারের একটা নীতিমালা থাকা অতিব জরুরি।
এসব বিষয়ে বেনাপোলের কয়েকজন সচেতন নাগরিক বলেন, দিনদিন নানা কারণে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার পণ্যে পরিণত হচ্ছেন অভিভাবকেরা। অভিভাবকদের যেমন এবিষয়ে সচেতন হতে হবে তেমনি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ কর্মকর্তাদেরও আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। কিছু শিক্ষককে শুধু বেতন তোলা মনোভাব ঝেড়ে ফেলে অজুহাত বাদ দিয়ে সৃজনশীল মানসিকতার হয়ে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করেন তারা। এর সঙ্গে জনগণের মৌলিক চাাহিদা ও অধিকারের মধ্যে শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেদিকেও সরকার ব্যাপক সংস্কার করবেন বলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
"