শোভন আহমেদ, ভেড়ামারা (কুষ্টিয়া)
হালিমা বেগম মাধ্যমিক বিদ্যালয়
অনুপস্থিত থেকেও ৫ মাস ধরে বেতন তুলছেন প্রধান শিক্ষক
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার হালিমা বেগম একাডেমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ মিললেও দীর্ঘ ৫ মাসেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। বরং যশোর শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন তারা।
অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে গত ৫ অগাস্টের পর থেকে বিদ্যালয়ে না গেলেও ৫ মাস ধরেই চালু রয়েছে তার বেতন। বিদ্যালয়ের ৩১ শিক্ষকের মধ্যে শফিক ও তার স্ত্রী বাদে ২৯ জনই অনাস্থা জানিয়েছে তার ওপর। ১৩টি অভিযোগের প্রতিটিতে অভিযুক্ত হয়েও কেন ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এ বিষয়ে উদ্বেগ আর হতাশা ব্যক্ত করেছেন শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী। হালিমা বেগম একাডেমি বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক অসিত কুমার পাল, প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় ১ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি যশোর শিক্ষা বোর্ডে লিখিত অভিযোগ করেন। ১৩টি অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপবৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের থেকে বেতন, ফি, ছাড়পত্র বাবদ অতিরিক্ত টাকা, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের থেকে অতিরিক্ত ফি নিয়ম বহির্ভূত নিতেন। তিনি এফডিআর এর লভ্যাংশ, বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে নেওয়া ফি, ছাড়পত্র বাবদ ফি, পুরাতন বই খাতা বিক্রির টাকা, ছাত্র-ছাত্রীদের জরিমানার টাকাসহ বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের অতিরিক্ত বরাদ্দের টাকা ক্যাশবুকে না উঠিয়ে নিজেই খরচ করতেন। অনিয়ম আর দুর্নীতির প্রত্যেকটি অভিযোগের সত্যতা পান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিয়ে গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি। প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে যশোর শিক্ষা বোর্ড প্রয়েজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও অদৃশ্য খুঁটির বলে বহাল তবিয়তেই রয়েছেন তিনি। প্রভাবশালী শফিকুল কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে ১৬ বছরে নিয়োগ দিয়েছেন ১১ শিক্ষক। প্রত্যেকের থেকে ঘুষ বাবদ আদায় করেছেন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শিক্ষকদের অভিযোগ, তৎকালীন সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে বিভিন্ন খাত থেকে আয় বাণিজ্য করেছেন কয়েক কোটি টাকা। বানিয়েছেন বহুতল বাড়ি। এত অনিয়ম, দুর্নীতির প্রমাণ এবং বিদ্যালয় থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা বের করে দিলেও তিনি এখনও ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে শিক্ষকদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, ভেড়ামারার হালিমা বেগম একাডেমির প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাজিরা খাতাতে ৫ আগস্টের পর থেকে টানা ৫ মাস অনুপস্থিত। কিন্তু বেতন তোলার যে বই সেখানে স্বাক্ষর করে প্রতি মাসেই নিয়েছেন মাসিক বেতন।
বোর্ডও তার সত্যতা পেয়েছে। শিক্ষা বোর্ড ২৭ আগস্ট প্রচলিত বিধি অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক শফিকুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়। গত ৩ সেপ্টেম্বর ভেড়ামারা ইউএনওর সভাপতিত্বে প্রধান শিক্ষককে শোকজ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি।
বিদ্যালয়টির শিক্ষক শাহিনুর রহমান বলেন, শফিকুর শুধুমাত্র উপবৃত্তি থেকেই ৫ লাখ ৮১ হাজার ৪৮৫ টাকা ১৬ কিস্তির মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংক থেকে তুলেছেন। তিনি দম্ভ করে বলতেন, সভাপতি আমার পকেটে। আমার যা ইচ্ছা তাই করব।
বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক ইলিয়াস হোসেন বলেন, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বানিয়েছিল হাসানুল হক ইনুর ছেলেকে। সদস্য নির্বাচন করতো ইচ্ছামত।
ভেড়ামারা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ বলেন, তার অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আমি কেউ নই। তাছাড়া এই বিষয়টি আমার দপ্তরের দেখভালের বিষয় নয়। তার বেতন ভাতা প্রদানে আমার কোনো হাত নেই। বিষয়টি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি দেখবে।
ভেড়ামারা ইউএনও রফিকুল ইসলাম কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোনো প্রকার ছুটি না নিয়েই ৫ মাস অনুপস্থিত, নিয়মিতভাবে বেতন তুলছেন, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? জবাবে তিনি বলেন, শফিকুল ইসলামের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পূর্বেকার ইএনও আকাশ কুমার কুন্ডু থাকা অবস্থায় তদন্ত হয়েছিল। তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে যশোর শিক্ষা বোর্ড প্রশাসনকে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেয়। আমি পদাধিকার বলে বিদ্যালয়টির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি থাকা অবস্থায় ৭ নভেম্বর একটি সভা ডেকেছিলাম। কিন্তু ৩ নভেম্বর শিক্ষা বোর্ড নতুন অ্যাডহক কমিটি নির্বাচনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাই আর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে তার সময়ে অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শফিকুরকে এক মাসের বেতন দেওয়ার বিষয়টি জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি নতুন, তাই দিয়েছি। তবে সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামী মাস থেকে সে যেন আর বেতন না পান, তার ব্যবস্থা নেবো। তবে তিনি কর্তৃপক্ষ কারো থেকে ছুটি না নিয়েই অনুপস্থিত আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
নানা অভিযোগে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তার স্ত্রী পলি খাতুনের মোবাইল ফোনে কথা বললেও অভিযুক্ত শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বক্তব্য দিতে রাজি হননি। গত রবিবার এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিকাল ৪টায় তার বাড়িতে গেলেও তিনি দেখা করেননি।
অভিযুক্ত শিক্ষক শফিকুল ইসলামের স্ত্রী পলি খাতুন বলেন, আমার স্বামীর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছুটি নিয়ে গত ৫ মাস স্কুলে যায়নি। তিনি স্বীকার করেন, সে নিয়মিতই বেতন পাচ্ছেন।
"