জুনাইদ কবির, ঠাকুরগাঁও

  ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

টাকা তুলতে হুমকি-হয়রানি দাদন ব্যবসায়ীর

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা আমির হোসেন। গাড়িতে মালামাল লোড-আনলোড (কুলির) কাজ করেন তিনি। সেই আয়ে তিন সন্তানসহ চালাতেন পরিবারের ৫ সদস্যের ভরণপোষণ। হঠাৎ করেই ডায়বেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে পারেননি। পরে স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ী আবু সাঈদের কাছে ৪০ হাজার টাকা নেন তিনি। পরে আবার ২০ হাজার টাকা নেন তার কাছে। দুই ধাপে নেওয়া ৬০ হাজার টাকাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তাদের। সুদসহ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেও ৬ লাখ টাকার মামলা দিয়েছেন আবু সাঈদ। এর আগে হুমকি-ধমকিসহ নানাভাবে হয়রানি করেছে আমিরের পরিবারকে।

আমিরের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, সাঈদ আসল টাকার জন্য হুমকি-ধমকি দেয়। পরে ৫ শতাংশ জমি বিক্রি করে ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করি। ১০ হাজার টাকা না দিতে পারায় ৬ লাখ টাকার মামলা দিয়েছে।

ভুক্তভোগী আমির বলেন, সাঈদের কারণে আমি ৩ মাস বাসা ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম। সারাদিন দিনমজুরের কাজ করি আর মামলার খরচ চালাই। আমি এটার সুষ্ঠু বিচার দাবি করি।

আমিরের মতোই আরো অনেকে সাঈদের জালে পা দিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন। সুদে-আসলে টাকা পরিশোধ করেও মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে মামলা, পুলিশ দিয়ে হয়রানি, বেঁধে পিটানোসহ নানা রকম নির্যাতনের শিকার এলাকার মানুষ। টাকা দেওয়ার আগে ফাঁকা চেক, স্ট্যাম্প ও জমির দলিল নেন তিনি। চেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে মামলা করেন সাঈদ। তার এমন কর্মকাণ্ডের শিকার কয়েক গ্রামের শতাধিক পরিবার।

সাঈদের কাছে দাদনের টাকা নেওয়া ভুক্তভোগীরা হলেন- ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা ঢোলারহাট ইউনিয়নের উত্তর বোয়ালিয়া গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে আলমগীর হোসেন, জালাল ঢাকায় পলাতক ছিল কয়েকমাস, ওই গ্রামের স্বাধীন রায়ের ছেলে গোপাল রায় ভারতে পালিয়েছেন, মাধবপুর গ্রামের শাহা আলম, একই গ্রামের আমির হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা বেগমসহ অনেকে।

ভুক্তভোগী ঢোলোরহাট এলাকার আবুল কালাম বলেন, সমস্যার কারণে আমি সাঈদের কাছ থেকে লাভের ওপর ৬০ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। পরে ১ বছরে শোধ করছি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। টাকা দুই মাস দেরি করে দেওয়ায় সে পুলিশ দিয়ে হুমকি দেয়।

ওই এলাকার আরেক ভুক্তভোগী আনোয়ার বলেন, সাঈদের কাছে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে সুদ দিয়েছি ১ লাখ ২০ হাজার। কয়েকমাস সুদ দিতে না পারায় সে পুলিশ পাঠিয়ে হুমকি দেয়। ভয়ে অন্য জেলায় পালিয়ে ছিলাম ৩ মাস।

২০ হাজার টাকা নেওয়ায় আমার নামে ৩ লাখ টাকার মামলা দিয়েছে সাঈদ। রাগে বলছিলেন আলী হোসেন আকবর। ৬০ হাজার টাকা শোধ করেছি। বিপদে পড়া মানুষের সুযোগ নিয়ে সে এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ।

ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে দাদন ব্যবসায়ী আবু সাঈদ ক্যামেরার সামনে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে গোপন ক্যামেরায় তার সঙ্গে গল্পে সে স্বীকার করে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু ৬ লাখ টাকার মামলা দিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন জনকে টাকা দেওয়ার বিষয়েও স্বীকার করেন আবু সাঈদ।

জেলার বিভিন্ন গ্রাম ও মহল্লায় ঘাঁপটি মেরে খেটে খাওয়া মানুষদের উপকারের নামে শোষণ করছেন দাদন ব্যবসায়ীরা। কেউ ব্যক্তিগতভাবে আবার কেউ সমবায় সমিতি থেকে অনুমোদন নিয়ে করছেন এমন অমানবিক কাজ। নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে এভাবে শোষণ থেকে মুক্তিতে দাদন ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনার দাবি সচেতন মহলের।

ঠাকুরগাঁও জেলা সমবায় কার্যালয়ের উপসহকারী নিবন্ধক একেএম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জেলায় ঋণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নিবন্ধিত সমবায় সমিতি প্রায় ৪০০টি। এ ছাড়া নিবন্ধন ব্যতীত দাদন ব্যবসার সমিতি রয়েছে সাত শতাধিক। যারা কোনো ধরনের নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব দাদন ব্যবসার বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারে। এসব বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জরুরি বলে মনে করি।

ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম বলেন, দাদন বা সুদ ব্যবসা ধর্মেই হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা অভিযোগ পেলে এবং কেউ প্রতারণা করছেন এমন অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close