শরীফ হোসাইন, ভোলা
ভোলা
মহিষ পালনে জীবিকা চরাঞ্চলের মানুষের
মহিষ পালন ভোলার একটি ঐতিহ্যগত পেশা। এখানকার অর্ধশতাধিক চরের মানুষ বংশপরাম্পরায় মহিষ পালন করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলার প্রায় অর্ধশতাধিক বিছিন্ন দ্বীপ চরগুলোতো প্রায় ২ শ বছর ধরে মহিষ বাতান আকারে পালন করে আসছেন চাষিরা। প্রতিটি মহিষের বাতানে ২ শ থেকে হাজার পর্যন্ত মহিষ পালন হয়ে থাকে। যা ঘরোয়া পরিবেশে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এ মহিষ পালন অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয়রা বসতবাড়ির গোয়াল ঘরে পালন শুরু করেছেন। মহিষ পালনের ব্যাপকতায় এলাকার দরিদ্র কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন।
একদিকে মহিষ বিক্রি, অন্যদিকে মহিষের দুধ বিক্রিতে লাভবান হচ্ছেন উপকূলের চাষিরা। দেখছেন দিন বদলের স্বপ্ন।
সংশ্লিষ্ট তথ্যসূত্র মতে, জেলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, তজুমদ্দিন, লালমোহন, চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক বিচ্ছিন্ন চর রয়েছে। এসব চরে সরকারি হিসেবে ২ লক্ষ ৬০ হাজার মহিষের হিসেব থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষাধিক। এখানে ৯৭টি মহিষের বড় বাতান (খামার) সহ প্রায় ৭০৫ দুগ্ধ খামার রয়েছে। এসব খামার থেকে প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার লিটার দুধ আসে। এসব দুধ ও দুধের তৈরি দই দিয়ে জেলার ২১ লক্ষ মানুষের চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন জেলায় চাহিদা পূরণ করছে। নদীর মাঝখানে এসব চরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এলাকা জুড়ে সবুজ ঘাসের সমারোহ। আর এসব চরে পালন করা হয় হাজার-হাজার মহিষ। সবুজ ঘাস খেয়ে পালিত হয় এসব মহিষ। যুগ যুগ ধরে বংশপরাম্পরায় বহু পরিবার এখানে মহিষ ও দই বিক্রির পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য তথ্যমতে, প্রায় ১২২০ সালে বঙ্গোপসাগর মোহনায় জেগে উঠে দ্বীপজেলা ভোলা। এরপর এখানে গত ৪শ’ বছর ধরে ক্রমশই জনবসতি গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হলে তারা মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়াসহ নানা জাতের গবাদিপশু পালন শুরু করেন। ভোলা দ্বীপ জনপদ হওয়াতে এখানকার ছোট-বড় অসংখ্য চরে মহিষ পালনে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। বিশেষ করে অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারগুলোর শত শত মহিষ পালন করতে তেমন বেগ পেতে হয় না।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় ২০০ বছর ধরে এ জেলায় মহিষের দুধ থেকে কাঁচা দই উৎপাদন শুরু করে। যা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময়েও জনপ্রিয়। এখানে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ এমন কোন সামাজিক অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দই দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়নি।
মহিষ পালনকারী ভোলার চরের মিন্টু খাঁ বলেন, মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০১ সালে ৪টি মহিষ নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এখন আমার ৪১টি মহিষ। বর্তমানে তার ২ একর জমি হয়েছে। যার বাজার মূল্য ২০ লাখ টাকা। এ মহিষের দুধ বেঁচে তিনি তার সংসারের খরচ মেটান।
ভোলায় এখন মহিষ পালনে চরাঞ্চলের সবাই ঝুঁকছে। এতোদিন শুধু বাতানে পালন হলেও এখন তা বাড়িতে বাড়িতে ঘরোয়া পরিবেশেও পালন হচ্ছে। মহিষ পালনে দিন বদলের এ গল্প জেলার অনেক কৃষকের।
ভোলার চর বৈরাগিয়ার মহিষের বাতান মালিক জাকির হাওলাদার বলেন, ৯৫টি মহিষ রয়েছে। এখন কৃমিনাশক ঔষুধ ও বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন দেয়ার কারণে মহিষ মারা যাওয়ার ঝুঁকি কমেছে। অন্যদিকে মাংস ও দুধের দাম বাড়ার কারণে লাভের পরিমানও বেড়েছে। এ মহিষ পালন করে প্রায় ৫ একর জমি কিনেছি।
মহিষের বাতানের অপর মালিক ইউনুছ মিয়া বলেন, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর চরে তাদের বাতানে প্রায় আড়াইশ মহিষ রয়েছে। দৈনিক এখান থেকে ১৩০ থেকে ১৫০ কেজি দুধ হয়।
স্থানীয় দধি বিক্রেতারা বলেন, সাধারণত দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের দই (টালির) চাহিদা বেশি। বর্তমানে দেড় কেজি ওজনের দধি ২৫০ ও ২ কেজি ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আশা করি, ভোলার মহিষের বাতান মালিকরা খুব শীঘ্রই এর সুফল পাবেন।
সব মিলিয়ে দ্বীপ ভোলার জনপদে আধুনিক প্রযুক্তিতে মহিষ পালন ও এর ব্যাপক প্রজনন সক্ষমতা দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে ঘুরে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
"