জুনাইদ কবির, ঠাকুরগাঁও

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

ঠাকুরগাঁওয়ের পরচুলা বিদেশে

বিশ্বের নামিদামি তারকাসহ অনেকের কাছেই পরচুলার ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সেই চিন্তায় দেশের উত্তরের ঠাকুরগাঁওয়ের নারীদের শ্রমে উৎপাদিত পরচুলা এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এ ক্ষুদ্র শিল্প গ্রামীণ নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

সদর উপজেলা জগন্নাথপুর ভালুকা গ্রামের উদ্যোক্তা কনিকা জানায়, বয়স যখন ১১ বছর তখন হঠাৎ করেই বাবা মারা যান। কোনো কাজ জোটাতে না পেরে তার মা ফাতেমা বেগম দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকার টঙ্গীর একটি ভাড়াবাসায় ওঠেন। সেখানে একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন তিনি। কনিকার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা পূরণ করানোর জন্য ভর্তি করা হয় একটি স্কুলে। সেখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া হয় তার। সামান্য আয়ে সংসার চলছিল না। মায়ের কষ্ট দেখে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়ে টঙ্গীর একটি হেয়ার ফ্যাশন কারখানায় কাজ নেন তিনি। মা-মেয়ের আয়ে সংসার বেশ ভালোই চলছিল। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তাকে বিয়ে দেন মা। এক অভাব থেকে আরেক অভাবের পথে সঙ্গী হন তিনি। বিয়ের কিছুদিন পরই দুই কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। সংসারে সদস্য বাড়লেও কিন্তু রোজগার বাড়েনি। অভাব মোচনের জন্য ঢাকায় স্বামীকে রেখে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন।

এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন কনিকা। তার স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করেন আরডিআরএস-বাংলাদেশ নামের স্থানীয় একটি এনজিও। সামান্য পুঁজি, সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হয় কনিকার পথচলা। উপজেলা জগন্নাথপুর ভালুকা গ্রামে স্বামীর বাড়ির উঠানে স্থাপন করেন চুলের টুপি (পরচুলা) তৈরির কারখানা। বিভিন্ন বিউটিপার্লার থেকে সংগ্রহ করেন নারীদের মাথার চুল। ওই চুল দিয়ে তৈরি করা হয় টুপি বা ক্যাপ। সাড়ে চার বছর আগে শুরু করা ক্ষুদ্র এ শিল্পটি বর্তমানে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। তার উৎপাদিত চুলের টুপি রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে।

জানা গেছে, কনিকা চার বছরে ভারত, দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, নেপালসহ প্রায় ১০টি দেশে পরচুলা রপ্তানি করেছেন। এতে করে গত ৪ বছরে ৭০ লক্ষাধিকের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছেন তিনি। এছাড়া চুলের টুপি তৈরি করে নিজে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, স্বাবলম্বী করেছেন অন্যদেরও। তার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামীণ জনপদের শতাধিক পরিবার।

কনিকা বেগম বলেন, একসময় একাই এই কাজ করতাম। প্রশিক্ষণ দিয়ে এখন অনেক শ্রমিক তৈরি করেছি। স্বামী ঢাকায় এই পণ্য বাজারজাতের কাজ করছেন। কারখানায় শ্রমিকের কাজ করছেন এলাকার শতাধিক নারী।

পরচুলা বানানো নারী শ্রমিক রিমু আক্তার বলেন, এখানে এক বছর ধরে কাজ করছি। যে টাকা উপার্জন করি তাতে লেখাপড়ার খরচ আসে। পরিবারকেও সহযোগিতা করতে পারছি।

পরচুলা বানানো স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখাবেশি রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের পরিশ্রমে প্রতিদিন তৈরি হয় কমপক্ষে ৩০-৪০টি টুপি। আর এই পরচুলা বিক্রির টাকায় চলে এসব শ্রমিকদের সংসার। কর্মহীন, বিধবা ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের দেয়া শুরু করেন পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ। এরপর আর থামেনি পথচলা। ঢাকার একটি পরচুলা তৈরির কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে পরচুলা সরবরাহ করেন কনিকা।

এই পরচুলাগুলো চলে যাচ্ছে ভারত, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে। মানুষের টাকমাথা, ফ্যাশন ও অভিনয় শিল্পীদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় এই পরচুলা বলে জানান কনিকা বেগম।

নারগুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল জলিল বলেন, এককালের দারিদ্র্য পীড়িত গ্রামটি এখন আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। কনিকা এখন সফল একজন নারী উদ্যোক্তা। তার মাধ্যমে অন্য নারীরা যেন স্বাবলম্বী হতে পারে সেজন্য জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতর কাজ করছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close